চীনের দারস্থ যুক্তরাষ্ট্র, হরমুজ প্রণালী খোলা রাখতে ইরানকে চাপের অনুরোধ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হরমুজ প্রণালী খোলা রাখার জন্য ইরানকে চাপ দিতে চীনের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এই বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন যে হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে চীনই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কারণ এই পথ দিয়েই তাদের সিংহভাগ তেল আমদানি হয়। তিনি আরও সতর্ক করেছেন যে এটি অন্যান্য দেশের অর্থনীতিতেও ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
রোববার (২২ জুন) সিবিএস নিউজের ‘ফেস দ্য নেশন’ অনুষ্ঠানে মার্কো রুবিও জানান, ইরান যদি হরমুজ প্রণালী বন্ধ করার মতো পদক্ষেপ নেয়, তবে সবার আগে চীনের সরকারকেই ক্ষুব্ধ হওয়া উচিত। তিনি বলেন, “যদি ইরান হরমুজ প্রণালীতে মাইন স্থাপন করে, তাহলে চীনকে চড়া মূল্য দিতে হবে এবং অন্যান্য দেশকেও মূল্য দিতে হবে। আমাদেরও দিতে হবে। প্রণালী বন্ধ হলে কিছু প্রভাব আমাদের ওপর পড়বে। পুরো বিশ্বের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। ইরান যদি এ কাজ করে তাহলে এটি তাদের জন্য বাণিজ্যিক আত্মহত্যা হবে।”
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেছেন যে, হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে এর বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে। তার এই মন্তব্য এমন এক সময়ে এলো যখন হরমুজ প্রণালীর নিরাপত্তা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ বাড়ছে। বিশেষ করে ইরান ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে এই গুরুত্বপূর্ণ জলপথের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। হরমুজ প্রণালী বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত সমুদ্রপথ, যা দিয়ে বিপুল পরিমাণ তেল ও গ্যাস পরিবহন করা হয়। এই প্রণালী দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো থেকে তেলবাহী জাহাজগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে তেল সরবরাহ করে।
হরমুজ প্রণালীর কৌশলগত গুরুত্ব
হরমুজ প্রণালী পারস্য উপসাগর এবং ওমান উপসাগরের মধ্যে অবস্থিত একটি সংকীর্ণ জলপথ। এটি ভৌগোলিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বিশ্বের মোট তেল পরিবহনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ এই প্রণালী দিয়েই সম্পন্ন হয়। সৌদি আরব, ইরাক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার এবং ইরানের মতো বড় তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো তাদের তেল রপ্তানির জন্য এই প্রণালীর ওপর নির্ভরশীল। তাই এই প্রণালীর নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারের জন্য অপরিহার্য। যেকোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা বিশ্ব অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।
যদি এই প্রণালী বন্ধ হয়ে যায়, তবে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম আকাশচুম্বী হবে, যা বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকট সৃষ্টি করতে পারে। এর ফলে বিভিন্ন দেশের শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হবে, পরিবহন ব্যয় বাড়বে এবং মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে। উন্নয়নশীল দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কারণ তাদের অর্থনীতি জ্বালানি মূল্যের ওপর অত্যন্ত সংবেদনশীল।
যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ এবং চীনের ভূমিকা
যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে হরমুজ প্রণালীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তারা এই অঞ্চলে তাদের নৌবাহিনী মোতায়েন করে আসছে যাতে আন্তর্জাতিক শিপিং লেনগুলো খোলা থাকে। ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বরাবরই উত্তেজনাপূর্ণ এবং তেহরান বিভিন্ন সময়ে এই প্রণালী বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। এই হুমকিগুলোকে যুক্তরাষ্ট্র তাদের জাতীয় নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য গুরুতর হুমকি হিসেবে দেখে।
মার্কো রুবিওর মন্তব্য অনুযায়ী, ইরান যদি প্রণালীটি বন্ধ করে, তবে চীনই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ চীনের অর্থনীতি দ্রুত বর্ধনশীল এবং তারা তাদের জ্বালানি চাহিদার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর heavily নির্ভরশীল। চীনের মোট তেল আমদানির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হরমুজ প্রণালী দিয়ে আসে। তাই প্রণালী বন্ধ হলে চীনের অর্থনীতিতে এক বিশাল চাপ সৃষ্টি হবে। এই কারণে যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, হরমুজ প্রণালী খোলা রাখতে চীন ইরানের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যা উভয় দেশের (যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের) স্বার্থের অনুকূল হবে।
চীনের সঙ্গে ইরানের কৌশলগত সম্পর্ক থাকলেও, চীনের নিজস্ব অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে তারা এই বিষয়ে নিরপেক্ষ থাকতে পারে না। চীন বিশ্বের বৃহত্তম তেল আমদানিকারক দেশ এবং তাদের অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বহুলাংশে জ্বালানি সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং, হরমুজ প্রণালীর নিরাপত্তা চীনের জন্য একটি প্রধান উদ্বেগের বিষয় হওয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্র আশা করছে, বেইজিং তার অর্থনৈতিক স্বার্থ বিবেচনা করে ইরানের ওপর প্রয়োজনীয় চাপ প্রয়োগ করবে যাতে তারা প্রণালীর স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত না করে।
ইরানের অবস্থান এবং পাল্টা পদক্ষেপের হুমকি
ইরান বারবার হরমুজ প্রণালী বন্ধ করার হুমকি দিয়েছে, বিশেষ করে যখন তাদের ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় বা তাদের পরমাণু কর্মসূচী নিয়ে চাপ সৃষ্টি করা হয়। ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (IRGC) এই অঞ্চলে নৌ মহড়া পরিচালনা করে এবং তাদের নৌ সক্ষমতা প্রদর্শন করে। তারা মনে করে, এই প্রণালী বন্ধ করার সক্ষমতা তাদের একটি ভূ-রাজনৈতিক অস্ত্র, যা তারা দর কষাকষির জন্য ব্যবহার করতে পারে।
তবে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এই ধরনের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্ট করে দিয়েছে যে তারা হরমুজ প্রণালী বন্ধ করার যেকোনো প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে কঠোর সামরিক পদক্ষেপ নেবে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর সাম্প্রতিক মন্তব্য এই সতর্কবার্তারই অংশ। তিনি বলেছেন, “আমাদেরও দিতে হবে। প্রণালী বন্ধ হলে কিছু প্রভাব আমাদের ওপর পড়বে। পুরো বিশ্বের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। ইরান যদি এ কাজ করে তাহলে এটি তাদের জন্য বাণিজ্যিক আত্মহত্যা হবে।”
এই পরিস্থিতি বিশ্বকে একটি নতুন সংকটের দিকে ঠেলে দিতে পারে। সামরিক সংঘাতের ঝুঁকি বাড়তে পারে এবং এর ফলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়তে পারে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টা
বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোও হরমুজ প্রণালীর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের অনেক দেশই মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর নির্ভরশীল। তাই তারা এই প্রণালীর স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও এই অঞ্চলে উত্তেজনা কমানোর এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য আহ্বান জানাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের চীনকে অনুরোধ করার বিষয়টি একটি নতুন কূটনৈতিক কৌশল হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র চাইছে, চীনের প্রভাব ব্যবহার করে ইরানকে সংযত রাখা যায়। যদিও চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে, তবে হরমুজ প্রণালীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা উভয় দেশেরই স্বার্থে। এই বিষয়ে সহযোগিতা সম্ভব হলে তা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য ইতিবাচক হতে পারে।
তবে, এই অনুরোধ চীন কীভাবে গ্রহণ করবে তা বলা কঠিন। চীন একদিকে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়, অন্যদিকে তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থও রক্ষা করতে চায়। এই দুটির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা চীনের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হবে।
ভবিষ্যতের পূর্বাভাস
হরমুজ প্রণালী ঘিরে উত্তেজনা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ ভবিষ্যতে ইরান, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্কের ওপর কী প্রভাব ফেলে তা দেখার বিষয়। যদি চীন এই বিষয়ে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে, তবে তা হরমুজ প্রণালীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক হতে পারে। তবে, যদি চীন এই অনুরোধ উপেক্ষা করে, তবে এই অঞ্চলে উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি সংকট আরও গভীর হতে পারে।
এই সময়ে কূটনৈতিক তৎপরতা এবং সংযম উভয় পক্ষের জন্য অপরিহার্য। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একত্রিত হয়ে এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য কাজ করতে হবে এবং সংঘাতের পথ পরিহার করতে হবে। হরমুজ প্রণালীর নিরাপত্তা কেবল মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর জন্য নয়, বরং পুরো বিশ্বের অর্থনীতির জন্য vital।