বিশ্ব

লেবানন থেকে মার্কিন নাগরিকদের সরে যাওয়ার নির্দেশ যুক্তরাষ্ট্রের

মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার পারদ চরমে। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন বোমারু বিমানের হামলার পর গোটা অঞ্চলে আবারও নিরাপত্তাজনিত অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে লেবানন থেকে মার্কিন নাগরিকদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান সামরিক উত্তেজনার প্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত কেবল সতর্কতামূলক নয়, বরং এটি ইঙ্গিত করছে যে পরবর্তী সময়ে আরও বড় ধরনের নিরাপত্তা সংকটের আশঙ্কা রয়েছে। এ নির্দেশনার আওতায় লেবাননে অবস্থানরত মার্কিন সরকারি কর্মকর্তাদের পরিবার এবং ‘অপ্রয়োজনীয়’ হিসেবে বিবেচিত কর্মীদের দ্রুত দেশটি ত্যাগ করার জন্য বলা হয়েছে।

নিরাপত্তা হুমকির মুখে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ

লেবাননে অবস্থানরত মার্কিন নাগরিকদের ই-মেইলের মাধ্যমে এই নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। মার্কিন দূতাবাসের পক্ষ থেকেও নাগরিকদের সতর্ক করে বলা হয়েছে, ‘বর্তমান নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে ভ্রমণ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।’ দূতাবাস আরও জানায়, পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হতে পারে এবং জরুরি ভিত্তিতে লেবানন ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘লেবাননে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সাম্প্রতিক সামরিক উত্তেজনার প্রেক্ষিতে মার্কিন নাগরিকদের নিরাপত্তা আমাদের জন্য অগ্রাধিকার। তাই কোনো জরুরি প্রয়োজনে না থাকলে দয়া করে এখনই লেবানন ত্যাগ করুন।’

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি: আগেও দেওয়া হয়েছিল এমন নির্দেশ

এই ধরনের সতর্কতা বা প্রত্যাহার নতুন নয়। এর আগেও, ২০২৪ সালের শেষের দিকে ইসরায়েল-লেবানন সীমান্তে হিজবুল্লাহ এবং ইসরায়েলি বাহিনীর সংঘাত শুরু হলে মার্কিন প্রশাসন একই ধরনের নির্দেশ দিয়েছিল। পরবর্তীতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সেই নির্দেশনা প্রত্যাহার করা হয়।

তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সাম্প্রতিক দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে। বিশেষত, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি বিমান হামলার পর পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে।

হামলার প্রেক্ষাপট: পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন বিমান হামলা

শনিবার (২১ জুন) মধ্যরাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী ইরানের একটি ‘গোপন পারমাণবিক স্থাপনায়’ বোমা বর্ষণ করে বলে দাবি করেছে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, ইরান এই কেন্দ্রটিকে শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে বলে জানালেও, তাদের কাছে নিশ্চিত তথ্য রয়েছে যে এটি একটি গোপন সামরিক প্রকল্প।

এই হামলার পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। হিজবুল্লাহ, হুথি বিদ্রোহী, শিয়া মিলিশিয়া এবং অন্যান্য ইরানঘনিষ্ঠ সংগঠনগুলো যুক্তরাষ্ট্র এবং এর মিত্রদের বিরুদ্ধে পাল্টা হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা।

মার্কিন সামরিক ঘাঁটি ও দূতাবাসগুলো হুমকির মুখে

ইরানের ঘনিষ্ঠ সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হামলার আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে ইরাক, সিরিয়া, কুয়েত, বাহরাইন এবং জর্ডানসহ একাধিক দেশের সামরিক ঘাঁটি ও দূতাবাসগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে। লেবাননেও মার্কিন দূতাবাসে সতর্কতা জারি করা হয়েছে।

পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ইরান সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর টার্গেটে বর্তমানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক কেন্দ্র, সামরিক ঘাঁটি এবং বিদেশে অবস্থানরত কর্মকর্তারা। সাইবার হামলার শঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

ট্রাম্প প্রশাসনের কৌশল: সুরক্ষাই প্রধান বিবেচনা

যদিও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনেকেই এই হামলার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন — যারা আবার ক্ষমতায় ফিরে এসেছে — জানিয়েছে, ‘আমরা আমাদের জনগণের নিরাপত্তার প্রশ্নে কোনো আপস করবো না।’

এক বিবৃতিতে ট্রাম্প বলেন, “আমরা আমাদের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। লেবানন বা অন্য যে কোনও ঝুঁকিপূর্ণ দেশে যদি মার্কিন নাগরিকদের জীবন হুমকির মুখে পড়ে, তবে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করব।”

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: উদ্বেগ, সমালোচনা এবং সতর্কতা

যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পররাষ্ট্র দফতরও সতর্ক হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়া নিজ নিজ নাগরিকদের লেবাননে অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ না করার পরামর্শ দিয়েছে।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মধ্যপ্রাচ্যের এই সামরিক উত্তেজনা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, “বিরোধ নয়, সংলাপই শান্তির পথ। এই মুহূর্তে সব পক্ষকে সংযম দেখাতে হবে।”

ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে?

বিশ্লেষকরা বলছেন, লেবাননে মার্কিন নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য সংঘাতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিশেষ করে হিজবুল্লাহর তৎপরতা বৃদ্ধি এবং ইসরায়েল সীমান্তে সামরিক মোতায়েনের কারণে লেবানন হতে পারে পরবর্তী সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দু।

অন্যদিকে, ট্রাম্প প্রশাসনের কৌশলে দেখা যাচ্ছে একপ্রকার আগ্রাসী প্রতিরোধনীতি। নিরাপত্তাজনিত হুমকি দেখা দিলেই সেখানে সামরিক বা কূটনৈতিক উপস্থিতি কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করছে না যুক্তরাষ্ট্র।

উপসংহার

মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতা এবং প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা বিশ্বের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। যুক্তরাষ্ট্রের লেবানন থেকে নাগরিক প্রত্যাহার কেবল একটি নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ নয়, বরং এটি আরও বড় সংকটের পূর্বাভাস হিসেবেও দেখা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এখনই কার্যকর কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করা, যাতে করে এই উত্তেজনা আর বড় কোনো সংঘাতে রূপ না নেয়।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button