বিশ্ব

গাজায় ১ লাখ ২৫ হাজার টন বিস্ফোরক ফেলেছে ইসরায়েল

Advertisement

ইসরায়েলি আগ্রাসনের ৬৫০তম দিনে গাজা সরকারের প্রতিবেদন প্রকাশ— বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত ৮৮ শতাংশ এলাকা সম্পূর্ণ ধ্বংস, ২০ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত এবং আর্থিক ক্ষতি ছাড়িয়েছে ৬২ বিলিয়ন ডলার। প্রাণহানির সংখ্যাও পৌঁছেছে লাখ ছুঁইছুঁই।

গাজায় আগ্রাসনের ভয়াবহ চিত্র

গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের চলমান সামরিক অভিযানে এখন পর্যন্ত অন্তত ১ লাখ ২৫ হাজার টন বিস্ফোরক ব্যবহারের তথ্য উঠে এসেছে। গাজা সরকারের জনসংযোগ বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই বিস্ফোরণের ফলে গাজার ৮৮ শতাংশ এলাকা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে, তার আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি ইতোমধ্যেই ৬২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই হামলা ইতোমধ্যে ৬৫০ দিন পার করেছে। এই সময়ে ২০ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে জোরপূর্বক নিজ ঘরবাড়ি থেকে বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে এবং গাজার মোট ৩৬০ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ৭৭ শতাংশ ভূখণ্ড এখন ইসরায়েলি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।

সহিংসতায় নিহত ও নিখোঁজদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক

প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলমান সংঘাতে এখন পর্যন্ত ৬৭ হাজার ৮৮০ জন ফিলিস্তিনি নিহত বা নিখোঁজ হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ১৯ হাজারের বেশি শিশু এবং ১২ হাজার ৫০০ নারী রয়েছেন। নারী নিহতদের মধ্যে ৮ হাজার ১৫০ জন মা এবং ৯৫৩ জন গর্ভবতী।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, হাসপাতালে পৌঁছানো মৃতদেহের সংখ্যা ৫৮ হাজার ৬৬৭ হলেও, ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া অনেকের লাশ এখনো উদ্ধার করা যায়নি। জনসংযোগ বিভাগ জানায়, অন্তত সাড়ে ৯ হাজার ফিলিস্তিনি এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে রয়েছেন।

ধ্বংসের শিকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ধর্মীয় অবকাঠামো

গাজার সামাজিক অবকাঠামোও এই আগ্রাসনের শিকার হয়েছে মারাত্মকভাবে। এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনী ৩৮টি হাসপাতাল, ৯৬টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং ১৪৪টি অ্যাম্বুলেন্স ধ্বংস করেছে। হামলার শিকার হয়েছে ১৫৬টি স্কুল, যার মধ্যে ৩৮২টি আংশিক ও সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত।

এছাড়াও, গাজায় ৮৩৩টি মসজিদ, ৩টি গির্জা এবং ৪০টি কবরস্থান লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে। এসব হামলায় ২ হাজার ৬১৩টি পরিবার পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে— যাদের আর কোনো সদস্য জীবিত নেই।

স্বাস্থ্য সংকট ও অপুষ্টিতে মৃত্যু

গাজার দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় হুমকির মুখে রয়েছে লাখো মানুষের জীবন। প্রায় ২০ লাখ মানুষ এখন বিভিন্ন সংক্রামক রোগে আক্রান্ত, যার মধ্যে অন্তত ৭১ হাজার হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হয়েছেন।

বিশেষ উদ্বেগের বিষয় হলো, খাদ্য ও চিকিৎসা সংকটে অন্তত ৬৮ জন শিশু অপুষ্টিতে এবং আরও ১৭ জন শিশু শীতে মারা গেছে। এখন পর্যন্ত আহত হয়েছে এক লাখ ৩৯ হাজার মানুষ, যাদের মধ্যে ৪ হাজার ৭০০ জনের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ কেটে ফেলতে হয়েছে।

সাংবাদিক, চিকিৎসক ও মানবিক কর্মীদের হতাহতের চিত্র

ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ১ হাজার ৫৯০ জন চিকিৎসাকর্মী, ২২৮ জন সাংবাদিক এবং ৭৭৭ জন মানবিক সহায়তা কর্মী নিহত হয়েছেন। এর পাশাপাশি, গাজা থেকে আটক করা হয়েছে মোট ৬ হাজার ৬৩৩ জন সাধারণ মানুষ, যাদের মধ্যে রয়েছেন ৩৬২ জন চিকিৎসাকর্মী, ৪৮ জন সাংবাদিক এবং ২৬ জন সিভিল ডিফেন্স কর্মী।

গাজার ভেতর তৈরি করা হয়েছে অন্তত সাতটি গণকবর, এবং কবরস্থান থেকেও ২ হাজার ৪২০টি মৃতদেহ তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

খাদ্য সংকট, ত্রাণ ঠেকানো এবং কৃষিক্ষেত্রে ধ্বংস

গত ১৩৯ দিনের বেশি সময় ধরে ইসরায়েল গাজায় ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করছে। এর ফলে খাদ্য সংকট চরমে পৌঁছেছে। কৃষিক্ষেত্রে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২.২ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ।

প্রায় ৯২ শতাংশ আবাদযোগ্য জমি এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত, যার ফলে গাজাবাসীর খাদ্য নিরাপত্তা অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। পানি, বিদ্যুৎ, পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাও কার্যত ধ্বংসপ্রাপ্ত।

ঘরহারা ও মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র

গাজায় ইসরায়েলি বোমা হামলায় প্রায় ২ লাখ ২৩ হাজার ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে এবং আরও ১ লাখ ৩০ হাজার বাড়ি বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এতে প্রায় ২ লাখ ৮৮ হাজার পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে।

বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয় কেন্দ্রগুলোর ২৬১টি সরাসরি হামলার শিকার হয়েছে। শিশুদের মধ্যে ৪৪ হাজার ৫০০ জন অন্তত একজন অভিভাবক হারিয়েছে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ভয়াবহ মনস্তাত্ত্বিক সংকট সৃষ্টি করতে পারে।

আন্তর্জাতিক সমাজের নিরবতা নিয়ে প্রশ্ন

গাজায় ইসরায়েলের সামরিক আগ্রাসন বিশ্ব বিবেককে বারবার নাড়া দিচ্ছে। গণহত্যার এই চিত্র এবং চরম মানবিক বিপর্যয়ের মুখে আন্তর্জাতিক সমাজের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে প্রতিনিয়ত।

বিশ্লেষকদের মতে, এ ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে যদি অবিলম্বে শক্ত অবস্থান গ্রহণ না করা হয়, তবে তা শুধু গাজারই নয়, বরং গোটা মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যতের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

এম আর এম – ০৪১৯, Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button