ট্রাম্পের ইরান হামলা ও যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় জড়িততা

২০২৫ সালের ২১ জুন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেন, মার্কিন সামরিক বাহিনী ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় তীব্র বোমা হামলা চালিয়েছে। এই ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার জন্য গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি এই অঞ্চলের যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলেছে। এই সংবাদটি শুধু সাম্প্রতিক নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্র, ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার দীর্ঘদিনের উত্তেজনার ধারাবাহিকতা ও জটিলতারও প্রতিফলন।
ট্রাম্পের ঘোষণা ও হামলার বিশদ
যুক্তরাষ্ট্রের সময় স্থানীয় রাত ৮টার কিছু আগে, ট্রাম্প নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যালে’ এই হামলার ঘোষণা দেন। তিনি লেখেন, “আমরা সফলভাবে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছি — ফর্দো, নাতাঞ্জ ও ইস্পাহান। আমাদের উড়োজাহাজগুলো নিরাপদে দেশে ফিরছে। প্রধান লক্ষ্য ছিল ফর্দো, যেখানে সর্বোচ্চ পরিমাণ বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে। এখন শান্তির সময়।”
ফর্দো হলো ইরানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূগর্ভস্থ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র, যা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সম্ভাবনাকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। হামলার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ইরানের পারমাণবিক সামর্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
কূটনৈতিক জটিলতা ও প্রতিবেশীদের ভূমিকা
এই হামলার দুই দিন আগেই হোয়াইট হাউস জানিয়েছিল, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দুই সপ্তাহের মধ্যে ইরানে হামলার সিদ্ধান্ত নেবেন। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা আগেই মার্কিন হামলার ব্যাপারে অবগত ছিলেন। হামলার পর ট্রাম্প ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করেন।
ইসরায়েল ও ইরানের বিরোধিতার পেছনে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ও সামরিক কারণ রয়েছে। ইসরায়েল বারবার ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী হয়েছে, আর যুক্তরাষ্ট্র তার ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে ইসরায়েলের কূটনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতা দিয়ে আসছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ
ট্রাম্পের এই হামলা ঘোষণা করার আগে হোয়াইট হাউসের অভ্যন্তরীন মহলে ব্যাপক মতবিরোধ ছিল। অনেক উপদেষ্টা ও কর্মকর্তারা হামলা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করলেও ট্রাম্প সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। একদল উপদেষ্টা চেয়েছিলেন, ইসরায়েলকে শুধু গোয়েন্দা সহযোগিতাই দিতে হবে, সরাসরি সামরিক সাহায্য নয়।
মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স বেশ কয়েক মাস ধরে ইরানের সরকারের পতনের বিপদের বিষয়ে সতর্ক করেছেন। যদিও ট্রাম্প বহুবার বলেছিলেন, তিনি বিদেশে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে যুক্ত হতে চান না, তবুও শেষ পর্যন্ত তিনি ইরানে সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছেন।
ইরানের প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ ঝুঁকি
ইরান থেকে এখনো হামলার ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি, তবে অনুমান করা হচ্ছে পারমাণবিক ক্ষমতা ও ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। ইরানের শীর্ষ নেতৃত্ব কিভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে তা এখনো অনিশ্চিত।
ট্রাম্প বলছেন, তিনি কূটনৈতিক সমাধানের পথে আগ্রহী, কিন্তু ইরানের পক্ষ থেকে তা বাস্তবায়িত হবে কিনা তা স্পষ্ট নয়। ইরান বিরোধী এ সংকট মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ভ্রষ্টতা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের নতুন অধ্যায়?
ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলা মধ্যপ্রাচ্যের বিদ্যমান সংঘাতকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে। ইসরায়েল ইতিমধ্যে ইরানে বোমা হামলা শুরু করেছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র গোয়েন্দা সহায়তা দিয়ে সহযোগিতা করছে। ট্রাম্প প্রশাসন শুরুর দিকে যুদ্ধ থেকে দূরে থাকার পক্ষপাতী ছিল, কিন্তু ইসরায়েলের সফল হামলার পর ট্রাম্প নিজেই এই অভিযানে নিজের ভূমিকা স্বীকার করেছেন।
২০২৫ সালের জুনে, কানাডায় জি-৭ সম্মেলনে যাওয়ার সময় ট্রাম্প বলেছেন, তাদের কাছে এমন শক্তিশালী বোমা আছে যা অন্য কোনো দেশের নেই, এবং সেই বোমা প্রয়োগের কথা ভাবা হচ্ছে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, যুক্তরাষ্ট্র আগামিতে আরও বড় ধরনের সামরিক পদক্ষেপ নিতে পারে।
ট্রাম্পের সামরিক নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার পর মার্কিন বাহিনীর মধ্যপ্রাচ্যে হস্তক্ষেপ ছিল দীর্ঘদিনের আলোচনার বিষয়। ট্রাম্প নিজে শুরু থেকেই বিদেশে সেনা পাঠানোর বিরুদ্ধে ছিলেন। তবে ইরানি জেনারেল কাসেম সোলাইমানি হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি অনেক অনড় সমর্থক ও সমালোচকদের মাঝে বিভক্তি তৈরি করেছিলেন। তার মতে, সোলাইমানি হত্যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করেছিল।
এবারের হামলাও ট্রাম্পের সেই রণনীতি ও আন্তর্জাতিক কূটনীতির প্রভাবের এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। তবে বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে কতটা সমর্থন পাবে এবং এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কী হবে, তা এখনও অস্পষ্ট।
বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া ও সম্ভাব্য পরিণতি
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয়তা ও ইরানে সামরিক হামলা বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। অনেক দেশ শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানাচ্ছে, আবার কেউ কেউ এই সামরিক পদক্ষেপকে ‘উত্তেজনা বৃদ্ধি’ হিসেবে দেখে।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভারসাম্যের জন্য এই সংঘাত মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে, তেল ও গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটতে পারে, যা আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ানোর সম্ভাবনা তৈরি করে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের ইরানে সামরিক হামলা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ভূগোলকে বদলে দিতে পারে। এই পদক্ষেপ কূটনৈতিক ও সামরিক জটিলতা বাড়িয়ে দিয়েছে, যা অঞ্চল ও বিশ্বের জন্য গভীর প্রভাব ফেলবে। এখন সময় এসেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সংহতি দেখিয়ে শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে।