হুতি সশস্ত্র গোষ্ঠীর হুঁশিয়ারি, ইরানে হামলা হলে মার্কিন জাহাজে হামলা হবে

ইয়েমেনের ইরান-সমর্থিত হুতি সশস্ত্র গোষ্ঠী সম্প্রতি এক কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইসরায়েলের পক্ষে ইরানের বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক হামলায় জড়িয়ে পড়ে, তাহলে তারা লোহিত সাগরে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ এবং বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে লক্ষ্য করে হামলা চালাবে। হুতিদের সামরিক মুখপাত্র ইয়াহিয়া সারির বরাতে ইয়েমেনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম এই তথ্য প্রকাশ করেছে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা জানিয়েছে, সারি বলেছেন, “জায়নবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কোনো আরব বা মুসলিম দেশের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে হুতিরা তাদের অবস্থানে অটল।”
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে হুতি বিদ্রোহীরা গাজার ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে লোহিত সাগর এবং এডেন উপসাগরে বাণিজ্যিক ও সামরিক জাহাজগুলোর ওপর হামলা চালিয়ে আসছে। এই হামলাগুলো বিশ্ব বাণিজ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে, বিশেষ করে তেল পরিবহনের ক্ষেত্রে। বিশ্লেষকদের মতে, হুতিদের এই কৌশল ইরানের আঞ্চলিক কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ, যার মাধ্যমে তারা লোহিত সাগরের মতো গুরুত্বপূর্ণ নৌপথে চাপ সৃষ্টি করছে।
হুতিদের হুঁশিয়ারির পটভূমি
ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সাম্প্রতিক উত্তেজনা মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি করেছে। গত সপ্তাহে ইসরায়েল ইরানের ওপর হামলা শুরু করলে হুতিরা ইরানের পক্ষে ইসরায়েলের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। ইয়েমেন থেকে ছোড়া একটি ক্ষেপণাস্ত্র পশ্চিম তীরের হেবরনে পৌঁছেছিল বলে ইসরায়েল স্বীকার করেছে। এই ঘটনার পর হুতিদের তৎপরতা আরও বেড়েছে, এবং তারা মার্কিন জাহাজগুলোকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
হুতিদের সামরিক মুখপাত্র ইয়াহিয়া সারি এক বিবৃতিতে বলেছেন, “যদি যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে মিলে ইরানের বিরুদ্ধে আক্রমণে জড়িত হয়, তাহলে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী লোহিত সাগরে মার্কিন জাহাজ ও যুদ্ধজাহাজগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করবে।” এই হুঁশিয়ারি এমন এক সময়ে এলো যখন মার্কিন যুদ্ধবিমানবাহী রণতরী ইউএসএস নিমিটজ দক্ষিণ চীন সাগর ছেড়ে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে রওনা দিয়েছে, যা আঞ্চলিক উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
হুতিদের পূর্ববর্তী হামলা ও মার্কিন প্রতিক্রিয়া
২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে হুতিরা লোহিত সাগরে প্রায় ১০০টির বেশি জাহাজে হামলা চালিয়েছে, যার মধ্যে দুটি জাহাজ ডুবে গেছে এবং চারজন নাবিক নিহত হয়েছে। এই হামলাগুলোর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা একাধিকবার হুতি-নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বিমান হামলা চালিয়েছে। গত ১৫ মার্চ মার্কিন সামরিক বাহিনী হুতিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক হামলা শুরু করে, যাতে কমপক্ষে ২৪ জন নিহত হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই হামলাকে “লোহিত সাগরে জাহাজে হুতিদের হামলার জবাব” হিসেবে অভিহিত করেছেন।
এছাড়া, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য যৌথভাবে হুতিদের ওপর বিমান হামলা চালায়, যা তেলের বিশ্ববাজারে ৪ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির কারণ হয়। হুতিরা এই হামলার জবাবে পাল্টা হুমকি দিয়ে বলে, “এই আগ্রাসনের শাস্তি ছাড়া যাবে না।”
চলতি বছরের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও হুতিদের মধ্যে একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যেখানে দুই পক্ষ একে অপরের বিরুদ্ধে হামলা না করার প্রতিশ্রুতি দেয়। তবে, হুতিরা জানিয়েছে, গাজায় ত্রাণ ও খাদ্য সরবরাহের ওপর ইসরায়েলের নিষেধাজ্ঞা না উঠলে তারা ইসরায়েল-সংশ্লিষ্ট জাহাজে হামলা চালানো অব্যাহত রাখবে।
ইরানের ভূমিকা ও আঞ্চলিক গতিশীলতা
হুতিদের পেছনে ইরানের সমর্থন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশ্লেষকদের মতে, হুতিদের সামরিক তৎপরতা ইরানের কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ, যার মাধ্যমে তেহরান মধ্যপ্রাচ্যে নিজের প্রভাব বিস্তার করছে। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ ইরানকে সতর্ক করে বলেছেন, “হুতিদের সমর্থন দেওয়ার জন্য ইরানকে পরিণতি ভোগ করতে হবে।”
ইরানের পক্ষ থেকেও হুমকি এসেছে। সম্প্রতি এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পক্ষে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়ালে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে হামলা চালাতে পারে। এই পরিস্থিতিতে হুতিরা লোহিত সাগরে মার্কিন জাহাজে হামলার মাধ্যমে ইরানের পক্ষে ভূমিকা পালন করতে পারে।
লোহিত সাগরের গুরুত্ব ও বৈশ্বিক প্রভাব
লোহিত সাগর বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ। এই পথ দিয়ে প্রতিদিন লক্ষাধিক ব্যারেল তেল এবং অন্যান্য পণ্য পরিবহন হয়। হুতিদের হামলার কারণে বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর ইনস্যুরেন্স খরচ ১০ গুণ বেড়ে গেছে, এবং অনেক শিপিং কোম্পানি এই পথ পরিহার করছে। ফলে মিশর, সুদান, ইথিওপিয়াসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক ও মানবিক সংকট তীব্রতর হয়েছে।
বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, হুতিরা যদি ড্রোন বা সমুদ্র মাইন ব্যবহার করে লোহিত সাগরের নৌপথ অচল করে দেয়, তাহলে তা বিশ্ববাজারে তেলের দামে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। এমনকি এই উত্তেজনা হরমুজ প্রণালী পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়লে বৈশ্বিক তেল সরবরাহের ২০ শতাংশ হুমকির মুখে পড়তে পারে।
হুতি গোষ্ঠীর উত্থান ও কৌশল
হুতিরা, যারা আনসার আল্লাহ নামেও পরিচিত, ইয়েমেনের জাইদি শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। ২০১৪ সাল থেকে ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে তারা দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চল, বিশেষ করে রাজধানী সানা এবং লোহিত সাগরের উপকূল নিয়ন্ত্রণ করে। ইরানের সমর্থনে তারা ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন এবং দ্রুতগামী নৌকা ব্যবহার করে হামলা চালায়।
হুতিদের কৌশলের মূল লক্ষ্য ইসরায়েল ও তার মিত্রদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের প্রতিবাদে তারা ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ইসরায়েল-সংশ্লিষ্ট জাহাজগুলোকে লক্ষ্য করে হামলা শুরু করে। এমনকি তারা ভুলবশত রাশিয়ান তেলবাহী একটি জাহাজেও হামলা করেছিল।
ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
হুতিদের সাম্প্রতিক হুঁশিয়ারি মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ড (সেন্টকম) জানিয়েছে, তারা হুতিদের হামলার সক্ষমতা কমাতে ইয়েমেনে ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করেছে। তবে হুতিরা এই হামলাকে “যুদ্ধাপরাধ” আখ্যায়িত করে পাল্টা হামলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ইয়েমেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে লোহিত সাগরে হুতিদের তৎপরতা শান্তি প্রক্রিয়ার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, বর্তমান উত্তেজনা যদি অব্যাহত থাকে, তবে তা মধ্যপ্রাচ্যে একটি বিস্তৃত আঞ্চলিক যুদ্ধের রূপ নিতে পারে, যার প্রভাব পড়বে বৈশ্বিক অর্থনীতি ও নিরাপত্তায়।