তিনজন উত্তরসূরি বেছে নিয়েছেন খামেনি

ইসরায়েলের সরাসরি হুমকির মুখে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি নিরাপত্তার স্বার্থে নিজ বাসভবন ছেড়ে রাজধানী তেহরানের একটি সুরক্ষিত বাংকারে আশ্রয় নিয়েছেন। রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেওয়ার কাজ অব্যাহত থাকলেও তিনি এখন যোগাযোগ করছেন শুধু নির্দিষ্ট, বিশ্বস্ত দূতের মাধ্যমে। যেকোনো প্রযুক্তি বা মোবাইল ফোন ব্যবহার থেকে বিরত রয়েছেন তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইরানের তিনজন শীর্ষ কর্মকর্তা মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসকে জানিয়েছেন, শীর্ষ নেতৃত্বে হঠাৎ পরিবর্তনের শঙ্কায় আয়াতুল্লাহ খামেনি বিকল্প নেতৃত্ব গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হিসেবে তিনি সম্ভাব্য তিনজন উত্তরসূরির নাম অনুমোদন করেছেন—যারা তাঁর মৃত্যুর পর ‘সর্বোচ্চ নেতা’ পদে দায়িত্ব পালনের জন্য বিবেচিত হবেন।
গুপ্তহত্যার হুমকি ও বাংকারে আশ্রয়
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ সম্প্রতি প্রকাশ্যে খামেনিকে ‘আধুনিক হিটলার’ বলে আখ্যায়িত করে বলেন, “তিনি আর বেশিদিন বেঁচে থাকবেন না।” তাঁর এ হুমকির পরই শুরু হয় উদ্বেগ। এর আগে মার্কিন গোয়েন্দা মহল জানিয়েছিল, ইসরায়েল খামেনিকে হত্যার পরিকল্পনা তৈরি করেছিল, যা যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভেটো দেন।
খবরে প্রকাশ, এই হুমকি গোপন কোনো পরিকল্পনা ছিল না, বরং সরাসরি আন্তর্জাতিক মাধ্যমে প্রচারিত হয়, যা ইরান সরকারের ভেতর এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। এ পরিস্থিতিতে খামেনি অত্যন্ত সতর্ক পদক্ষেপ হিসেবে তার বাসস্থান ত্যাগ করে বাংকারে চলে যান।
তিন সম্ভাব্য উত্তরসূরি
সর্বোচ্চ নেতার দায়িত্ব একটি অতীব স্পর্শকাতর ও ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ। খামেনি তাঁর ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাদের নিয়ে জরুরি আলোচনার ভিত্তিতে সম্ভাব্য উত্তরসূরিদের তালিকা তৈরি করেছেন, যাতে দেশ নেতৃত্বশূন্য না হয়।
এই তালিকায় যাদের নাম রয়েছে, তাদের মধ্যে খামেনির পুত্র মোজতাবা খামেনি নেই—যদিও এতদিন পর্যন্ত বেশিরভাগ বিশ্লেষক ধারণা করেছিলেন, খামেনি মৃত্যুর পর এই দায়িত্ব পুত্রকেই দিতে পারেন। খামেনি স্পষ্টভাবে উত্তরসূরিদের বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, ধর্মীয় গ্রহণযোগ্যতা এবং জনমতের গুরুত্বকে প্রাধান্য দিয়েছেন বলে কর্মকর্তারা জানান।
সামরিক নেতৃত্বেও রদবদল
ইসরায়েলি হামলায় ইতিমধ্যে ইরানের একাধিক শীর্ষ সামরিক কমান্ডার নিহত হয়েছেন। পরিস্থিতি বিবেচনায় খামেনি সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতেও রদবদল করেছেন। কয়েকজন নতুন সামরিক কমান্ডারকে নিযুক্ত করা হয়েছে, যারা ইসরায়েলি হামলার সম্ভাব্য পাল্টা জবাব এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখবেন।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই পদক্ষেপগুলো নেয়া হয়েছে একদম নিঃশব্দে, যেন দেশজুড়ে আতঙ্ক না ছড়িয়ে পড়ে। সেনা বাহিনীর অভ্যন্তরে নতুন নেতৃত্বের মাধ্যমে একটি শক্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েলের প্রকাশ্য হুমকি ও ইরানের প্রতিক্রিয়ার মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে উত্তেজনার সঞ্চার হয়েছে। ইতিমধ্যে আরব দেশগুলোর একটি অংশ ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিলেও, কূটনৈতিকভাবে অনেকেই নীরব ভূমিকা পালন করছে।
ওয়াশিংটনে একাধিক গোপন বৈঠক হয়েছে বলে জানা গেছে, যেখানে খামেনিকে হত্যা না করার বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সংবাদমাধ্যমে বলেন, “আমরা জানি আয়াতুল্লাহ খামেনি কোথায় আছেন, তবে আপাতত তাঁকে হত্যা করব না।”
এই বক্তব্য ইরানের দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো সান্ত্বনার বার্তা নয় বরং একটা চলমান হুমকির ইঙ্গিত হিসেবেই ধরা হচ্ছে। ফলে খামেনির বিকল্প প্রস্তুতির সিদ্ধান্তকে দেশব্যাপী একটি প্রয়োজনীয় কৌশল হিসেবে দেখা হচ্ছে।
উত্তরসূরি ঠিক করার রাজনৈতিক তাৎপর্য
খামেনির উত্তরসূরি বাছাইয়ের বিষয়টি শুধু ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জন্য নয়, বরং গোটা মধ্যপ্রাচ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ৮৬ বছর বয়সী খামেনি প্রায় তিন দশক ধরে এই দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে দেশটিতে শক্তিশালী রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হতে পারে, যা নতুন করে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পরিস্থিতিতে খামেনির দূরদর্শী সিদ্ধান্ত দেশকে একটি সুশৃঙ্খল উত্তরাধিকারের পথে রাখবে এবং সম্ভাব্য ক্ষমতার লড়াই থেকেও রক্ষা করবে।
উপসংহার
বর্তমানে ইরানের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব একটি সংকটকাল অতিক্রম করছে—বাইরের হুমকি ও ভেতরের অস্থিরতা একসঙ্গে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি নিজেকে সরিয়ে নিয়ে নেতৃত্বের জন্য বিকল্প কাঠামো দাঁড় করানোর যে কৌশল নিয়েছেন, তা শুধু ইরান নয়, পুরো অঞ্চলের রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।