বিশ্ব

যুক্তরাষ্ট্রের বি-২ স্টেলথ বোমারু বিমান প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে যাচ্ছে

যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বি-২ ‘স্পিরিট’ স্টেলথ বোমারু বিমান দেশটির পশ্চিম উপকূল থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন করে উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে। এই বিমানের গতিবিধি ইরানে সম্ভাব্য হামলার প্রস্তুতি হিসেবে দেখা হচ্ছে, যদিও হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি দেওয়া হয়নি। তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ঘিরে এটাই কি যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক চাপ তৈরির কৌশল—তা নিয়েও বিশ্লেষকদের মধ্যে চলছে নানা মত।

বি-২ বোমারু বিমানের গন্তব্য ও ক্ষমতা

নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের মিজৌরির হোয়াইটম্যান বিমানঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করেছে এই স্টেলথ বোমারু বিমানগুলো। উড্ডয়নের দিকনির্দেশনা ও এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল সূত্রে জানা গেছে, বিমানগুলো গুয়ামের দিকে রওনা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গুয়ামে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি রয়েছে, যেখান থেকে পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে সামরিক তৎপরতা চালানো সম্ভব। যদিও নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, তারা এই গন্তব্য নিশ্চিত করতে পারেনি।

আল–জাজিরার পৃথক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিমানগুলো মূলত ভারত মহাসাগরের দিয়েগো গার্সিয়া ঘাঁটির উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়েছে। এই ঘাঁটিতে মোতায়েনের অর্থ, একবার রিফুয়েলিং করেই বিমানগুলো ইরানে আঘাত হানতে পারবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ঘাঁটি থেকে বি–২ বিমান ইরানের ফর্দো পারমাণবিক স্থাপনায় সরাসরি হামলার কৌশল বাস্তবায়ন করতে সক্ষম।

কেন এত আলোচনায় বি-২ ‘স্পিরিট’?

বি–২ স্টেলথ বোমারু বিমান হলো যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে উন্নত ও অত্যাধুনিক বোমারু প্ল্যাটফর্ম। এই বিমান ৩০,০০০ পাউন্ড ওজনের ‘বাঙ্কার–বাস্টার’ বোমা বহনে সক্ষম, যা ভূগর্ভস্থ লক্ষ্যবস্তু ধ্বংসে ব্যবহৃত হয়। ইরানের যেসব পারমাণবিক স্থাপনা মাটির গভীরে নির্মিত, বিশেষ করে কুমের কাছে অবস্থিত ফর্দো পারমাণবিক স্থাপনা, সেগুলোর বিরুদ্ধে হামলা চালাতে এই বোমা বিশেষভাবে কার্যকর বলে সামরিক বিশ্লেষকদের ধারণা।

বি–২ এর স্টেলথ প্রযুক্তি বিমানটিকে রাডারের নজর এড়িয়ে চলার সক্ষমতা দেয়, যা এটি শত্রুর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে প্রবেশ করে সুনির্দিষ্ট হামলা চালাতে পারে। ফলে এ ধরনের একটি মোতায়েন যে কেবল শক্তির প্রদর্শন নয়, বাস্তব হামলার প্রস্তুতি হিসেবেও দেখা হচ্ছে।

হোয়াইট হাউসের অবস্থান ও ট্রাম্পের পরিকল্পনা

চলমান উত্তেজনার মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিউ জার্সি থেকে হোয়াইট হাউসে ফিরছেন শনিবার বিকেলে। এর আগে গত বৃহস্পতিবার তিনি জানিয়েছিলেন, ইরানের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার আগে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার জন্য আরও দুই সপ্তাহ সময় নিচ্ছেন। তবে সূত্রমতে, ইরানে হামলার পরিকল্পনা এরই মধ্যে অনুমোদন করেছেন ট্রাম্প। এ পরিস্থিতিতে বি-২ বিমানের গতি এবং প্রস্তুতি এক ধরনের সামরিক চাপ প্রয়োগ এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য আক্রমণের ইঙ্গিত হিসেবেই দেখা হচ্ছে।

কূটনীতি না সামরিক কৌশল?

বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিস্থিতি ঘিরে দুটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে—একটি হলো ইরানকে সামরিকভাবে চাপে রাখা এবং কূটনৈতিকভাবে কিছু ছাড় আদায় করা, অন্যটি সরাসরি সামরিক হামলার পূর্ব প্রস্তুতি। যুক্তরাষ্ট্র অতীতে বহুবার এমন বোমারু মোতায়েনের মাধ্যমে প্রতিপক্ষ রাষ্ট্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। ২০১৭ সালে উত্তর কোরিয়াকে কেন্দ্র করেও অনুরূপ কৌশল দেখা গিয়েছিল।

তবে এবারের পরিস্থিতি একটু ভিন্ন। কারণ, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের উদ্বেগ বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে যখন খবর এসেছে যে ইরান গোপনে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম বাড়িয়েছে এবং আইএইএ পরিদর্শকদের সীমিত প্রবেশাধিকার দিয়েছে।

তেহরানের প্রতিক্রিয়া কী?

ইরানের পক্ষ থেকে এখনও পর্যন্ত বি–২ বিমানের মোতায়েন বিষয়ে সরাসরি কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি। তবে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বারবার বলছে, তারা কূটনীতিকে অগ্রাধিকার দিতে চায়। তেহরান দাবি করেছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ, এবং পশ্চিমা দেশগুলোর ‘চাপ ও হুমকি’ তাদের অবস্থান বদলাবে না।

তবে ইরানের সামরিক বাহিনীর একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আল–জাজিরাকে বলেন, “আমরা জানি যুক্তরাষ্ট্র কী করছে এবং তার জবাব দেওয়ার জন্য আমাদের প্রস্তুতি আছে।”

উপসংহার: আগুনের খেলা?

বর্তমান অবস্থায় স্পষ্ট করে বলা কঠিন—যুক্তরাষ্ট্র আসলে সত্যিকারের হামলার দিকে অগ্রসর হচ্ছে, নাকি কৌশলগতভাবে ইরানকে কোনঠাসা করতে চাচ্ছে। তবে যেভাবে সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন করা হচ্ছে এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাম্প্রতিক অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, খুব শিগগিরই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি নাটকীয় মোড় আসতে পারে।

বি–২ বোমারু বিমানের মোতায়েন শুধুই সামরিক প্রদর্শনী নাকি আসন্ন যুদ্ধের আলামত—তা নির্ভর করবে আগামী কয়েক সপ্তাহে ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যে কূটনৈতিক কথোপকথনের গতিপথের ওপর।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button