প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার সম্পদ একশ’র বেশি সন্তানকে দেবেন টেলিগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা

টেলিগ্রাম মেসেজিং অ্যাপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রযুক্তি উদ্যোক্তা পাভেল দুরভ এক ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন—প্রায় ১৩.৯ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের সম্পদ তিনি ভাগ করে দেবেন তার ছয়টি জৈবিক সন্তান এবং শুক্রাণু দানের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া শতাধিক শিশুর মধ্যে।
বিবিসি নিউজের এক প্রতিবেদনে শুক্রবার (২০ জুন) জানানো হয়, ফরাসি রাজনীতি বিষয়ক সাময়িকী ‘ল্য পয়েন্ট’-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এই ঘোষণা দিয়েছেন দুরোভ। তিনি বলেন, “তারা সবাই আমার সন্তান এবং তাদের সবার সমান অধিকার থাকবে। আমি চাই না আমার মৃত্যুর পর তারা একে অপরের সঙ্গে লড়াই করুক।”
১৫ বছরের শুক্রাণু দানের ফল: শতাধিক সন্তান
পাভেল দুরভ জানান, ১৫ বছর আগে এক বন্ধুর অনুরোধে তিনি একটি ক্লিনিকে শুক্রাণু দান শুরু করেন। সেই ক্লিনিকের তথ্যমতে, বর্তমানে পৃথিবীর অন্তত ১২টি দেশে দুরভের শুক্রাণু থেকে জন্ম নিয়েছে ১০০টিরও বেশি শিশু।
তিনি বলেন, “আমি জানতাম না এটি এতদূর বিস্তৃত হবে। তবে ক্লিনিক আমাকে নিশ্চিত করেছে যে আমি এই শিশুদের জৈবিক পিতা। আমি তাদের দায়িত্ব নিচ্ছি এবং আমার উইলে তাদের উত্তরাধিকার অন্তর্ভুক্ত করেছি।”
এই সিদ্ধান্ত তার ব্যক্তিত্বের একটি ব্যতিক্রমী দিক তুলে ধরে, যেখানে সম্পদ বিতরণের ক্ষেত্রে তিনি বংশগত বন্ধনের বাইরেও নৈতিক দায়িত্ববোধে বিশ্বাসী।
সন্তানদের জন্য উত্তরাধিকার: ৩০ বছর পর
দুরোভ জানান, তার জৈবিক ও দানকৃত শুক্রাণু থেকে জন্ম নেওয়া সন্তানরা কেউই ৩০ বছর বয়সের আগে এই উত্তরাধিকার পাবেন না। তিনি বলেন, “আমি চাই তারা নিজেরা নিজেদের গড়ে তুলুক। আত্মবিশ্বাসী হোক, সৃজনশীল হোক, এবং শুধু উত্তরাধিকার কিংবা ব্যাংক ব্যালেন্সের ওপর নির্ভরশীল না হয়।”
এই দৃষ্টিভঙ্গি তার ব্যক্তিগত জীবন ও কাজের নীতির প্রতিফলন। দুরোভ সবসময়ই স্বাধীনতা, সৃজনশীলতা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তার পক্ষে সোচ্চার।
টেলিগ্রাম ও দুরোভের বর্তমান অবস্থান
৪০ বছর বয়সী এই প্রযুক্তি উদ্যোক্তা রাশিয়ায় জন্মগ্রহণ করলেও বর্তমানে তিনি থাকেন দুবাইয়ে। টেলিগ্রামের সদর দফতরও এখন সেখানে। তার ফ্রান্স ও সংযুক্ত আরব আমিরাত—দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে।
২০১৩ সালে তিনি টেলিগ্রাম চালু করেন। গোপনীয়তা ও এনক্রিপশন ব্যবস্থার জন্য টেলিগ্রাম আজ বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়। বর্তমানে এর মাসিক সক্রিয় ব্যবহারকারী সংখ্যা ১০০ কোটিরও বেশি।
ফ্রান্সে গ্রেফতার ও অভিযোগ
সাক্ষাৎকারে দুরোভ বলেন, ফ্রান্সে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলি ভিত্তিহীন এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত। গত বছর ফ্রান্সে তাকে গ্রেফতার করা হয় টেলিগ্রামে অপরাধ সংক্রান্ত কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার অভিযোগে।
তবে দুরোভ স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “শুধু এই কারণে যে অপরাধীরা আমাদের মেসেজিং পরিষেবা ব্যবহার করে, তা আমাদের অপরাধী করে তোলে না।”
তিনি অভিযোগ করেন, “মাদক পাচার, শিশু পর্নোগ্রাফি এবং জালিয়াতির মতো অপরাধ রুখতে আমরা যথাসাধ্য কাজ করছি। কিন্তু আমাদের এই দায়িত্বে সীমা আছে, এবং আমরা প্রযুক্তি, স্বাধীনতা ও গোপনীয়তার সীমানা রক্ষা করি।”
টেলিগ্রামের সমালোচনা ও জবাব
বিভিন্ন দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দাবি, টেলিগ্রাম যথাযথভাবে অপরাধ দমনে সহযোগিতা করে না। বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে, চরমপন্থী গোষ্ঠী এবং অপরাধীরা এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
যুক্তরাজ্যে একাধিক সহিংস ঘটনার পেছনে টেলিগ্রাম-ভিত্তিক চ্যানেলগুলোর ভূমিকা থাকার অভিযোগে এই অ্যাপটি সমালোচিত হয়। টেলিগ্রাম কিছু চ্যানেল বন্ধ করলেও, সাইবার নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, এখনও টেলিগ্রামের কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা দুর্বল।
সমাজ ও প্রযুক্তিতে দুরোভের প্রভাব
পাভেল দুরোভ এমন একজন ব্যক্তি, যিনি আধুনিক প্রযুক্তির দুনিয়ায় গোপনীয়তা ও স্বাধীনতার পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। তার সিদ্ধান্ত—উত্তরাধিকার ভাগ করে দেয়া, কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণে তার সীমিত হস্তক্ষেপ এবং ক্ষমতা বিতরণের আদর্শ—সমাজে এক নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
তিনি বলেন, “আমরা এমন একটি সমাজ গড়তে চাই যেখানে তথ্যের স্বাধীনতা, গোপনীয়তা ও ব্যক্তি-অধিকার সংরক্ষিত থাকে। আমি চাই না আমার সন্তানরা শুধু টাকার উত্তরাধিকার পেয়ে বেড়ে উঠুক। বরং তারা যেন নিজের যোগ্যতায় সমাজে অবদান রাখতে পারে।”
সমাপ্তি কথা
পাভেল দুরভের এই ঘোষণাটি কেবল একটি আর্থিক পরিকল্পনা নয়; এটি সমাজে এক গভীর বার্তা দেয়। প্রযুক্তি উদ্যোক্তা হিসেবে যেমন তিনি সমাজকে পরিবর্তন এনেছেন, তেমনি একজন পিতা ও মানবিক নাগরিক হিসেবে তার এই সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতের উত্তরাধিকারের ধরন এবং নৈতিকতার ব্যাখ্যার পথও প্রসারিত করেছে।