জাতিসংঘে ইরানের প্রতিনিধিকে আক্রমণ ইসরাইলের

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সঙ্কট আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বৈঠকে ইরানের স্থায়ী প্রতিনিধি আমির সাঈদ ইরাভানি যখন আন্তর্জাতিক আইন রক্ষার আহ্বান জানান এবং ইসরাইলের সামরিক কর্মকাণ্ডকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেন, তখন ইসরাইলের প্রতিনিধি ড্যানি ড্যানন তীব্র ভাষায় ইরাভানির বক্তব্যের পাল্টা দেন।
ড্যাননের বক্তব্য ছিল অভূতপূর্ব কড়াচ্য, যেখানে তিনি ইরাভানিকে “একজন নেকড়ে, যিনি কূটনীতিকের মুখোশ পরে এসেছেন” বলে অভিহিত করেন। তিনি আরও বলেন, “মি. ইরাভানি, আপনি কোনো ভিকটিম নন। বরং আপনি সেই দেশের প্রতিনিধি, যে দেশ আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে।”
ইসরাইলি অবস্থান ও প্রতিক্রিয়া:
ড্যাননের ভাষ্য অনুযায়ী, ইরান সম্প্রতি বিয়ারশেভা শহরের একটি হাসপাতালে নিকটবর্তী এলাকায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। যদিও ইরান এ অভিযোগ অস্বীকার করে এবং দাবি করে যে, তাদের লক্ষ্য ছিল একটি সামরিক ঘাঁটি। তবু ড্যানন বলেন, “আমরা আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করেছি এবং করবো। এর জন্য আমরা কারও কাছে ক্ষমা চাই না।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর জন্য দুঃখ প্রকাশ করি না। বরং আমরা হুমকি দূরীকরণের ক্ষেত্রে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছি। যারা এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করছেন, তারা প্রকৃত নিরাপত্তা চায় না।”
রাশিয়ার অবস্থান:
জাতিসংঘে রাশিয়ার প্রতিনিধি ভাসিলি নেবেনজিয়া এ ঘটনায় ইসরাইলের অবস্থানের কড়া সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, “ইসরাইল কূটনৈতিক প্রচেষ্টার প্রতি স্পষ্ট অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছে এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে জাতিসংঘ সনদের সম্মান না দেখিয়ে একতরফাভাবে ইরানের ওপর হামলা চালিয়েছে।”
নেবেনজিয়া আরও যোগ করেন, “এ ধরনের কার্যক্রম আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার ওপর আস্থা দুর্বল করে এবং যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। জাতিসংঘ সনদের মৌলিক নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতি এ ধরনের আচরণ অগ্রহণযোগ্য।”
ইরানের প্রতিক্রিয়া:
ইরানি প্রতিনিধি আমির সাঈদ ইরাভানি তার বক্তব্যে জোর দিয়ে বলেন, “ইসরাইল নিয়মিতভাবে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে এবং অসামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে আন্তর্জাতিক শান্তিকে হুমকির মুখে ফেলছে। বিশ্বের শক্তিগুলোকে এখনই কার্যকর হস্তক্ষেপ করতে হবে, নইলে এই আগ্রাসন বিস্তৃত হতে পারে।”
তিনি ড্যাননের বক্তব্যকে ‘উস্কানিমূলক ও ভিত্তিহীন’ বলে প্রত্যাখ্যান করেন এবং বলেন, “এটি কূটনৈতিক পরিবেশকে ধ্বংস করে দেবে। ইরান শান্তি চায়, তবে আত্মরক্ষার জন্য আমাদেরও প্রস্তুত থাকতে হবে।”
বিশ্ব সম্প্রদায়ের আহ্বান:
জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীনসহ অন্যান্য দেশের প্রতিনিধি উভয় পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধি বলেন, “বর্তমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে আলোচনার পথেই সমাধান খোঁজা উচিত। প্রতিটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো শান্তি রক্ষা করা এবং কূটনৈতিক মাধ্যমেই সমাধানের পথ খুঁজে বের করা।”
চীনের দূত বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা শুধু সেই অঞ্চলের নয়, বরং পুরো বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমরা প্রত্যাশা করি, ইসরাইল ও ইরান উভয়ই পরিস্থিতি বিবেচনায় সংযম প্রদর্শন করবে।”
সম্প্রতি ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনা একাধিকবার ঘটেছে। ইরান দাবি করেছে, তাদের প্রতিক্রিয়ামূলক হামলা ছিল আত্মরক্ষার অংশ। অন্যদিকে, ইসরাইল বলছে, তাদের প্রতিটি হামলা ছিল সুনির্দিষ্ট হুমকি মোকাবিলার প্রয়া
বিশ্লেষকদের মতে, এই দুই শক্তিশালী দেশের সংঘাত যদি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে না আনা যায়, তবে তা বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে। বিশেষ করে জাতিসংঘে প্রতিনিধিদের এ ধরনের সরাসরি ব্যক্তিগত আক্রমণ কূটনৈতিক পরিবেশকে আরও জটিল করে তুলছে।
বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যৎ শঙ্কা:
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বাকযুদ্ধ ও সামরিক সংঘর্ষ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নীতিমালা ও নিরাপত্তা কাঠামোর বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘের নিরপেক্ষতা ও শান্তিপূর্ণ আলোচনার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ভূমিকা দিন দিন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে।
তারা আরও বলেন, ইসরাইলের এই অবস্থান একটি দৃঢ় বার্তা দিলেও, তা আন্তর্জাতিক সহানুভূতির দিক থেকে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। একইসঙ্গে, ইরানের পাল্টা কৌশল ও আঞ্চলিক জোটগুলো পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে।
উপসংহার:
জাতিসংঘে এই কূটনৈতিক বাকযুদ্ধ কেবল দু’টি দেশের মধ্যকার উত্তেজনাই নয়, বরং তা গোটা বিশ্বের নিরাপত্তার জন্য একটি হুঁশিয়ারি সংকেত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এখনই কার্যকর ও নিরপেক্ষ হস্তক্ষেপ নিশ্চিত করা, যাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে না চলে যায়। ইসরাইল ও ইরান— উভয় পক্ষকে এখন সংযম ও কূটনৈতিক পথ বেছে নেওয়ার সময়।