সংঘাত থামাতে বৈঠকে নেতারা, কোন নেতা কী বলছেন

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত নিরসনে বর্তমানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক চলছে। একটি সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ইউরোপীয় নেতাদের অংশগ্রহণে এবং অন্যটি আমেরিকার নিউইয়র্কে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে। উভয় বৈঠকেই সংঘাতের মূল কারণ এবং সমাধান নিয়ে বিভিন্ন পক্ষ তাদের নিজ নিজ অবস্থান তুলে ধরছে। এই মুহূর্তে সংঘাতের অবসানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ ও ঐক্যের মিশ্র সুর শোনা যাচ্ছে।
জেনেভার বৈঠক: ইউরোপের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা
সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ সংঘাত নিরসনে একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি উল্লেখ করেন, ফ্রান্স এবং তাদের ইউরোপীয় মিত্ররা ইরানে একটি প্রস্তাব নিয়ে যাবেন, যার চারটি উপাদান ইতিমধ্যেই প্রস্তুত করা হয়েছে। ম্যাখোঁ জোর দিয়েছেন যে, এই প্রস্তাবের সফলতার জন্য ইরানের সদিচ্ছা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক সমাধানের ওপর যে জোর দেওয়া হচ্ছে, তা ম্যাখোঁর বক্তব্যে স্পষ্ট। তিনি বিশ্বাস করেন, সংলাপ এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমেই এই দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের একটি টেকসই সমাধান সম্ভব।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি এই সংঘাতের কূটনৈতিক সমাধানের জন্য আগামী দুই সপ্তাহের সময়সীমা নির্ধারণ করেছেন। তার মতে, এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে একটি ফলপ্রসূ সমাধান খুঁজে বের করা জরুরি। ল্যামি এমন এক সময়ে এই মন্তব্য করেছেন যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলে হামলায় সঙ্গ দেবেন কিনা, তা জানিয়ে দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের ওপর এই সংকটের ভবিষ্যৎ অনেকটা নির্ভর করছে, যা ল্যামির মন্তব্যে পরোক্ষভাবে উঠে এসেছে। তার বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, পশ্চিমা দেশগুলো দ্রুত একটি সমাধান চাইছে, যাতে পরিস্থিতি আরও খারাপ না হয়।
জেনেভায় নিযুক্ত ইসরায়েলি অ্যাম্বাসেডর দানিয়েল মেরন এই বৈঠকে তার দেশের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন যে, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের পরমাণু কর্মসূচি থেকে সরে আসার কথা বলবেন। ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের দাবি, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এই মন্তব্যের মাধ্যমে মেরন আবারও ইরানের পরমাণু কর্মসূচির উপর আন্তর্জাতিক নজরদারি এবং নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন। তার ভাষ্যমতে, পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য।
অন্যদিকে, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগসি বলেছেন, ইসরায়েল হামলা বন্ধ করলেই কেবল তারা আমেরিকার সঙ্গে সমঝোতার আলোচনায় প্রবেশ করবেন। এই শর্ত ইরানের পক্ষ থেকে একটি স্পষ্ট বার্তা। আরাগসি জোর দিয়েছেন যে, আলোচনার জন্য একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ অপরিহার্য। তার মতে, চলমান হামলা বন্ধ না হলে কোনো ফলপ্রসূ আলোচনা সম্ভব নয়। এই শর্ত থেকে বোঝা যায়, ইরানও আলোচনার টেবিলে বসতে প্রস্তুত, তবে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পর।
নিউইয়র্কে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক
আমেরিকার নিউইয়র্কে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক চলছে, যেখানে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা উপস্থিত রয়েছেন। এই বৈঠকে ইরানের অ্যাম্বাসেডর আমির-সাইয়িদ ইরাভানি ইসরায়েলি হামলায় নিহতদের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি একটি বোমা হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ইরানি শিশুর ছবি দেখিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং এই হামলার বিষয়ে জাতিসংঘকে পদক্ষেপ নিতে তাগিদ দেন। ইরাভানির বক্তব্য ছিল আবেগপূর্ণ এবং মানবিক, যা সংঘাতের মানবিক বিপর্যয়কে তুলে ধরেছে। তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এই হামলার বিরুদ্ধে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।
নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন অ্যাম্বাসেডর দোরোথি ক্যামিলে শেয়া এই সংঘাতের জন্য ইরানকেই মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তার মতে, ইরানকে তাদের পরমাণু কর্মসূচির আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করতে হবে। এই বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের অবস্থানের প্রতিচ্ছবি। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে যে, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি এবং আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাই এই সংঘাতের মূল কারণ। শেয়ার বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্র এই সংকটের সমাধানে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির সম্পূর্ণ অবসান দেখতে চায়।
এই হামলার জন্য রাশিয়া সরাসরি ইসরায়েলকে দায়ী করছে। রাশিয়ার পক্ষ থেকে ইসরায়েলের উপর চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে সংঘাত নিরসনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অন্যদিকে, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস উল্লেখ করেছেন যে, ইরানের সঙ্গে তাদের একটি বড় ‘গ্যাপ’ তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে পরমাণু কার্যক্রমের ক্ষেত্রে। গুতেরেসের এই মন্তব্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে গভীর উদ্বেগ এবং অবিশ্বাসের ইঙ্গিত দেয়। তিনি আশা করেন, সংলাপের মাধ্যমে এই গ্যাপ কমানো সম্ভব হবে, তবে তার বক্তব্যে সমস্যার গভীরতা পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে।
সংঘাতের ভবিষ্যৎ ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি
এই দুটি বৈঠক থেকে স্পষ্ট যে, ইরান-ইসরায়েল সংঘাত একটি জটিল রূপ নিয়েছে, যেখানে বিভিন্ন পক্ষ তাদের নিজস্ব স্বার্থ ও দাবি নিয়ে অবস্থান করছে। একদিকে ইউরোপীয় দেশগুলো কূটনৈতিক সমাধানের চেষ্টা করছে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের পরমাণু কর্মসূচি ত্যাগের ওপর জোর দিচ্ছে। রাশিয়া ইসরায়েলকে দোষারোপ করছে, এবং জাতিসংঘ সংঘাতের মানবিক বিপর্যয় নিয়ে উদ্বিগ্ন।
এই পরিস্থিতিতে সংঘাতের ভবিষ্যৎ অনেকটাই অনিশ্চিত। যদি আলোচনার মাধ্যমে কোনো সমাধান না আসে, তবে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঐকমত্য এবং চাপই এই সংঘাত নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এই মুহূর্ত পর্যন্ত, কোনো পক্ষই তাদের অবস্থান থেকে পুরোপুরি সরে আসতে রাজি নয়, যা সমাধানের পথকে আরও কঠিন করে তুলছে। আগামী দুই সপ্তাহকে ডেভিড ল্যামি যে সময়সীমা হিসেবে উল্লেখ করেছেন, তা এই সংকট নিরসনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। এই সময়ের মধ্যেই যদি কোনো যুগান্তকারী পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।