আইডিএফ প্রধান ‘দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের’ জন্য ইসরায়েলিদের প্রস্তুত থাকতে হবে

ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যকার উত্তেজনার আবহে, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) চিফ অফ স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়াল জামির শুক্রবার এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তায় ইসরায়েলি নাগরিকদেরকে ‘দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের’ জন্য মানসিক ও বাস্তবিক প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এই বার্তাটি এক ভিডিও বক্তব্যে প্রদান করেন তিনি, যা “টাইমস অব ইসরায়েল”-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও সাড়া ফেলে।
জেনারেল জামির বলেন, “ইরান বছরের পর বছর ধরে ইসরায়েলকে ধ্বংস করার সুপরিকল্পিত ও অবিচল এক রণকৌশলের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে এই পরিকল্পনা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখান থেকে ফিরে আসার কোনো উপায় নেই।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা যখন এই অভিযান শুরু করি, তখন ইরানের কাছে আনুমানিক ২,৫০০ ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ছিল। তবে তাদের উৎপাদন ক্ষমতা এতটাই বেশি যে, ধারণা করা হয়েছিল, দুই বছরের মধ্যেই এই সংখ্যা ৮,০০০-এ পৌঁছে যাবে।”
পারমাণবিক কর্মসূচি ও আঞ্চলিক হুমকি
আইডিএফ প্রধানের মতে, ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রস্তুত কর্মসূচি, পারমাণবিক কর্মসূচির ধাপে ধাপে অগ্রগতি এবং মধ্যপ্রাচ্যে হিজবুল্লাহ ও অন্যান্য প্রক্সিদের মাধ্যমে ইসরায়েলবিরোধী কার্যক্রম ক্রমশ ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকিতে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, “আমরা যদি দেরি করতাম, তাহলে ইসরায়েলের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়ে যেত। আমাদের দায়িত্ব হলো ইহুদি জাতির অস্তিত্ব রক্ষা, যা আমরা অবহেলা করতে পারি না। ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।”
জেনারেল জামির আরো বলেন, “আইডিএফ সবসময় অস্তিত্বগত হুমকিকে প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত ছিল এবং থাকবে। আমরা আগেভাগেই আঘাত হানার নীতি অনুসরণ করছি, যাতে প্রতিপক্ষকে চমকে দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়।”
প্রথম দফা অভিযানের ‘সফলতা’
ইরানের বিরুদ্ধে আইডিএফের প্রথম আকস্মিক হামলা নিয়ে তিনি বলেন, “আমরা ইরানের সিনিয়র সামরিক কমান্ডকে লক্ষ্য করে অভিযান চালিয়েছি। এর ফলে তাদের পারমাণবিক প্রকল্পের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। একইসঙ্গে তেহরানের আকাশসীমায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে প্রায় অর্ধেক ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চার ধ্বংস করেছি, যা ইরানকে বিস্মিত করেছে।”
এই ‘সফলতা’ প্রসঙ্গে জামির বলেন, “এই সাফল্য স্বল্পমেয়াদী হলেও তা যুদ্ধের রূপ পাল্টে দিয়েছে। এখন আমাদের যুদ্ধ দীর্ঘ হবে, তা আমরা জানি। সেজন্য হোম ফ্রন্ট প্রতিরক্ষাকেও গুরুত্ব দিয়ে আমরা সমান্তরালভাবে কার্যক্রম চালাচ্ছি।”
বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা
আইডিএফ প্রধান স্পষ্ট করে বলেন, “ইরান ও তাদের সহযোগী বাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে। এই ধরনের আচরণ যুদ্ধনীতি ও মানবিক নীতিমালার পরিপন্থী। এ কারণে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী কেবল সীমান্তে নয়, দেশের অভ্যন্তরেও সম্ভাব্য প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি জোরদার করেছে।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, “আমরা এখন এমন এক জটিল ও ব্যাপক অভিযানে প্রবেশ করেছি, যা আমাদের ইতিহাসে নজিরবিহীন। এই যুদ্ধ হবে দীর্ঘমেয়াদি এবং এর জন্য সামগ্রিক প্রস্তুতি প্রয়োজন।”
জাতির প্রতি বার্তা
ভিডিও বার্তার শেষাংশে ইয়াল জামির বলেন, “ইসরায়েলের প্রিয় নাগরিকগণ, আমরা উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছি ঠিকই, তবে সামনে আরও কঠিন চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে, ধৈর্য ধারণ করতে হবে এবং সর্বোপরি আত্মবিশ্বাস বজায় রাখতে হবে। কারণ জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আমাদের সম্মিলিত সহনশীলতা ও প্রতিরোধ ক্ষমতার উপর।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও পরিপ্রেক্ষিত
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সম্প্রতি সতর্ক করে বলেছেন, “ইসরায়েল-ইরান সংঘাত দ্রুত একটি বিস্তৃত আঞ্চলিক সংকটে রূপ নিতে পারে, যার প্রভাব পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে পারে।” একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ইসরায়েলের এই ‘প্রতিরোধমূলক আগ্রাসন’ কেবল ইরানের নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে।
উপসংহার
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা প্রধানের এই স্পষ্ট ও কৌশলগত বিবৃতি শুধু দেশবাসীকেই সতর্ক করেনি, বরং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলোকেও একবারে যুদ্ধের নতুন বাস্তবতা উপলব্ধি করতে বাধ্য করেছে। পরিস্থিতির ক্রমবিকাশ এবং নতুন প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি এখন পুরোপুরি মধ্যপ্রাচ্যের দিকে নিবদ্ধ।