বিশ্ব

ইরানে হামলার সিদ্ধান্তের আগে ২ সপ্তাহ সময় দিলেন ট্রাম্প

যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনা যখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, তখনই একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত জানালেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সম্ভাব্য সামরিক হামলার আগে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার জন্য আরও দুই সপ্তাহ সময় দিয়েছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে এ সিদ্ধান্তকে একটি বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে।

বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে বিষয়টি নিশ্চিত করেন প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন ল্যাভিট। তিনি বলেন, “ইরানের সঙ্গে যেকোনো ধরনের চুক্তির শর্তাবলির মধ্যে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রাখার বিষয়টি অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে।”

তিনি আরও বলেন, “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্পষ্টভাবে তার আগের অবস্থানে অটল রয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র কোনো অবস্থাতেই ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের সুযোগ দেবে না।”

ইরান-যুক্তরাষ্ট্র বিরোধের প্রেক্ষাপট

গত কয়েক মাস ধরেই মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমাগত বাড়ছে উত্তেজনা। বিশেষ করে ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। যুক্তরাষ্ট্র বারবার অভিযোগ করে আসছে, ইরান গোপনে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাধ্যমে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে অগ্রসর হচ্ছে। যদিও ইরান বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে এবং বলছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যেই পরিচালিত হচ্ছে।

২০২৫ সালের শুরু থেকেই ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘর্ষমূলক কার্যক্রম বেড়ে গেছে। এর প্রেক্ষাপটেই যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ইরানবিষয়ক নীতিতে একটি কড়া অবস্থান গৃহীত হয়। এ বছরের মে মাসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের একটি বৈঠকে ইরানের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য সামরিক অভিযান নিয়ে আলোচনা করেন।

সামরিক পথ নয়, কূটনীতি প্রাধান্য পাবে

বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের এই দুই সপ্তাহ সময় বাড়ানো কূটনৈতিক প্রচেষ্টার একটি সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (IAEA), জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন কূটনৈতিক শক্তিগুলো এখন নতুন করে সক্রিয় হতে পারবে।

প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন ল্যাভিট বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়। তবে তা ইরানের শর্তে নয়, বরং একটি নিরাপদ বিশ্বের লক্ষ্যে। আমরা বিশ্বাস করি, এই দুই সপ্তাহ সময় কূটনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।”

ইউরোপীয় প্রতিক্রিয়া

হোয়াইট হাউসের বিবৃতির পরপরই ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক বিবৃতিতে ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। তারা বলেছে, “আমরা বিশ্বাস করি এই সময়ের মধ্যে একটি শান্তিপূর্ণ ও কার্যকর সমঝোতার পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব। ইরানকে অবশ্যই পরমাণু কার্যক্রমে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে হবে এবং আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে।”

জার্মানি, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্য ইরানের সঙ্গে একটি মধ্যস্থতা আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে। তাদের পক্ষ থেকে দ্রুত একটি কূটনৈতিক টাস্কফোর্স গঠনের পরিকল্পনাও করা হয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্য ও ইসরায়েলের উদ্বেগ

ট্রাম্প প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত ইসরায়েলের উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলেছে। কারণ ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রকে আহ্বান জানিয়ে আসছিল যেন তারা দ্রুত ও কার্যকর সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী এক বিবৃতিতে বলেন, “ইরান একটি বিপজ্জনক রাষ্ট্র। তাদেরকে সময় দেয়া মানে আরও বড় হুমকির মুখোমুখি হওয়া।”

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন প্রশাসন ইসরায়েলের উদ্বেগকে গুরুত্ব দিলেও বিশ্ব কূটনীতির বড় স্বার্থে এই মুহূর্তে সরাসরি সামরিক পদক্ষেপে যেতে চাইছে না।


চীন ও রাশিয়ার অবস্থান

চীন ও রাশিয়া, যারা ইরানের প্রধান মিত্র বলে বিবেচিত, ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক বলেই উল্লেখ করেছে। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা মনে করি সংঘর্ষ নয়, আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্র যদি কূটনীতিকে অগ্রাধিকার দেয়, আমরা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।”

রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ও জানায়, “আমরা ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপের ঘোর বিরোধিতা করছি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কূটনৈতিক সময়সীমা নির্ধারণ একটি বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত।”

বিশ্লেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. হুমায়ুন কবির বলেন, “ট্রাম্প প্রশাসন চাপ এবং শান্তির মধ্যে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করছে। এই দুই সপ্তাহ কূটনৈতিক আলোচনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে ইরান যদি তেমন কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রস্তুতি কার্যকর হতে পারে।”

আরেকজন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক মেরিনা হক বলেন, “ইরান যদি নিজেদের পরমাণু কর্মসূচি স্বচ্ছ না করে, তাহলে এই সময়টা শুধু সময় নষ্ট হবে। তবে আমরা আশা করতেই পারি, দুই পক্ষই কোনো না কোনো বাস্তবিক সমঝোতায় পৌঁছাবে।”

সমাপ্তি ভাবনা

বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এমন এক সময়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দুই সপ্তাহ সময় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত বিশ্ববাসীকে কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছে। তবে এই সময়ের মধ্যেই ইরান যদি গঠনমূলক ভূমিকা না নেয়, তাহলে ভবিষ্যতে একটি সামরিক সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। আগামী কয়েকদিনই নির্ধারণ করবে, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ভূচিত্র কোন দিকে মোড় নেবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button