নেপিদো কারাগারে অং সান সু চির ৮০তম জন্মদিন উদযাপন

মিয়ানমারের গণতন্ত্রের প্রতীক, নেত্রী অং সান সু চি আজ ১৯ জুন ২০২৫ তারিখে তাঁর ৮০তম জন্মদিন পালন করছেন। কিন্তু এই জন্মদিনটি উদযাপন করছেন না সাধারণ কোনো আড্ডায় বা আনন্দ উৎসবে; বরং দেশের সামরিক জান্তার কারাগারে বন্দী অবস্থায় কাটছে তাঁর দিন। দীর্ঘ বছর ধরে চলা রাজনৈতিক সংকট ও সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে এখনো তিনি কারাগারে রয়েছেন।
অং সান সু চির জীবন ও সংগ্রামের সংক্ষিপ্ত বিবরণ
অং সান সু চি মিয়ানমারের স্বাধীনতা সংগ্রামী অং সানের কন্যা। ১৯৮৮ সালে তিনি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। বিদেশে দীর্ঘ সময় থাকার পর অসুস্থ মাকে দেখতে মিয়ানমারে ফিরে এসে জনতাকে নেতৃত্ব দিয়েছেন গণতন্ত্রের পথে। যদিও তাকে ১৫ বছর গৃহবন্দী রাখা হয়, তবে সাহসিকতার জন্য তিনি ১৯৯১ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান।
২০১৫ সালের নির্বাচনে তাঁর দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) জয়ী হলেও সামরিক জান্তার তৈরি বাধার কারণে তিনি দেশের প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক জান্তা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তাঁকে আটক করে। এরপর থেকে তিনি কারাগারে রয়েছেন।
কারাগারে জন্মদিনের করুণ বাস্তবতা
এই ৮০তম জন্মদিনে সু চি নেপিদোর কারাগারে বন্দী। সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে দেশজুড়ে গেরিলা যুদ্ধ চলছে। কারাগারে তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ ব্যাপক। তাঁর ছেলে কিম অ্যারিস, যিনি যুক্তরাজ্যে বসবাস করেন, বলছেন, “আমরা জানি না মা কেমন আছেন, গত দুই বছরে শুধু একটি চিঠি পেয়েছি।”
তবুও, কিম তাঁর মায়ের জন্মদিনকে স্মরণীয় করতে ৮ দিনে ৮০ কিলোমিটার দৌড় সম্পন্ন করেছেন। সেই সাথে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে মায়ের জন্য ৮০ হাজারের বেশি শুভেচ্ছাবার্তা ভিডিও সংগ্রহ করেছেন।
অং সান সু চির রাজনৈতিক অবস্থান ও আন্তর্জাতিক জনপ্রিয়তা
মিয়ানমারের মধ্যে সু চি এখনও জনপ্রিয়, বিশেষ করে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মধ্যে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাঁর জনপ্রিয়তা ও মর্যাদা কিছুটা কমে গেছে। কারণ, রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর সেনাবাহিনীর নির্যাতনের সময় তিনি সেনাবাহিনীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন, যা বিশ্বব্যাপী সমালোচনার মুখে পড়েছে।
রোহিঙ্গা সংকটের কারণে অনেক পুরস্কার এবং সম্মাননা যারা একসময় তাকে দিয়েছিলেন, তারা এখন দূরত্ব বজায় রাখছেন। আন্তর্জাতিক দৃষ্টিতে তার অবস্থান এখন কঠিন।
সামরিক সরকারের স্বাস্থ্য তথ্য এবং পরিবারিক উদ্বেগ
মিয়ানমারের সামরিক সরকার মাঝে মাঝে সু চির স্বাস্থ্য বিষয়ে সীমিত তথ্য প্রকাশ করে। ২০২৫ সালের মার্চ মাসে সরকারি মুখপাত্র জানিয়েছেন যে সু চি সুস্থ আছেন এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে। তবে কিম অ্যারিস বলছেন, তাঁর মায়ের হৃদযন্ত্র, দাঁত ও হাড়ের চিকিৎসা ভালোভাবে হচ্ছে না।
সামরিক জান্তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও সু চির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ
মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ২০২৫ সালের শেষে নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে। তবে দেশটির বেশিরভাগ বিরোধী দল এই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। অনেকেই জান্তা বিরোধী হয়ে অস্ত্র হাতে গেরিলা যুদ্ধ করছেন।
কিম অ্যারিস মনে করেন, যদি সু চি মুক্তি পান, তাহলে হয়তো তিনি আর সরাসরি রাজনৈতিক নেতৃত্বে থাকবেন না। দেশের সংকটের জন্য নতুন প্রজন্মের কাছে সুযোগ দিতে চাইবেন।
সার্বিক পর্যালোচনা: মিয়ানমারের গণতন্ত্র ও সু চির সংগ্রাম
মিয়ানমারের ইতিহাসে অং সান সু চির নাম গণতন্ত্র আন্দোলনের প্রতীক। দীর্ঘদিন ধরে তিনি দেশকে সামরিক শাসনের গহ্বর থেকে মুক্ত করার জন্য লড়াই করেছেন। তার নেতৃত্বে অনেক আশা জেগেছিল, কিন্তু সামরিক জান্তার প্রতি তার অস্পষ্ট মনোভাব ও রোহিঙ্গা সংকটের সময়ের সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিকভাবে তার ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
তবুও, দেশের অভ্যন্তরে সু চির জনপ্রিয়তা এখনো কমেনি। মানুষের অনেকেই তাকে গণতন্ত্রের একমাত্র আশা হিসেবে দেখেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁর বন্দিত্ব এবং সামরিক জান্তার দমন-পীড়নের মধ্যেও দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন থেমে নেই।
বিশেষ তথ্য
- ৮০তম জন্মদিন উদযাপনে বিশেষ উদ্যোগ: ছেলে কিম অ্যারিস ৮ দিনে ৮০ কিলোমিটার দৌড়িয়েছেন।
- শুভেচ্ছাবার্তা সংগ্রহ: বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৮০ হাজারের বেশি ভিডিও মেসেজ এসেছে।
- সামরিক জান্তার অভিযোগ: দুর্নীতি, কোভিড বিধি লঙ্ঘনসহ নানা মামলায় ২৭ বছরের কারাদণ্ড প্রাপ্ত।
- আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি: রোহিঙ্গা সংকট ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে সমালোচনার মুখে।
অং সান সু চির ৮০তম জন্মদিনের দিনটি মিয়ানমারের গণতন্ত্রের দীর্ঘ যাত্রার প্রতিফলন। ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক সংগ্রামের গল্প, সামরিক শাসনের কঠোরতা এবং আন্তর্জাতিক সমালোচনা মিলেমিশে গড়ে তুলেছে এক জটিল পরিসর।
সু চি কারাগারে বন্দী অবস্থায় থাকলেও, তার নাম এখনও গণতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে উচ্চারিত হয়। ভবিষ্যতে তার মুক্তি ও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন হবে, তা সময়ই বলবে।