ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় তেলের দামে উঠানামা

মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম এক ধরণের উত্তেজনার মুখে পড়েছে। গত কয়েকদিন ধরে তেলের মূল্য ওঠানামার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা সরাসরি প্রভাব ফেলছে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও জ্বালানি নিরাপত্তায়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, তা স্পষ্ট না হওয়ায় বাজারে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা ও তেলের সরবরাহ ঝুঁকি
মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান উত্তেজনা ও সম্ভাব্য সামরিক সংঘাত তেলের সরবরাহ বিঘ্নিত করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। বিশেষ করে হরমুজ প্রণালী, যেখান দিয়ে বিশ্ববাজারে সমুদ্রপথে পরিবাহিত তেলের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ যান, সেখানে কোনো সমস্যা হলে তেলের দাম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে। আইএনজি ব্যাংকের বিশ্লেষকদের মতে, হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে তেলের দাম ১২০ ডলার পর্যন্ত ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে।
ইরান মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্রধান তেল উৎপাদনকারী দেশ, যা প্রতিদিন প্রায় ৩৩ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল উৎপাদন করে। ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান উত্তেজনার কারণে বিশ্ববাজারে তেলের সরবরাহ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের বক্তব্যে তেলের বাজারে অনিশ্চয়তা
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি সম্প্রতি ট্রাম্পের ‘শর্তহীন আত্মসমর্পণ’ আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছেন। অন্যদিকে, ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, তাঁর ধৈর্যের সীমা শেষ, কিন্তু তিনি পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে তা স্পষ্ট করেননি। হোয়াইট হাউসের বাইরে সাংবাদিকদের কাছে ট্রাম্প জানান, ‘আমি হয়তো করব, হয়তো করব না—আসলে কেউই জানে না আমি কী করব।’ এর ফলে বাজারে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ইসরায়েলের সঙ্গে মিলে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়, তাহলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি অবকাঠামো বিপন্ন হবে, যা তেলের দাম আরও বৃদ্ধি করতে পারে। রিটারবুশ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বর্তমান উত্তেজনার কারণে ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৮৩ ডলারে পৌঁছতে পারে।
তেলের দাম ওঠানামা ও বিশ্ববাজারের প্রতিক্রিয়া
গতকাল বুধবার বিশ্ববাজারে ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ব্যারেলপ্রতি ৭৬.৭০ ডলার, যা আগের দিনের তুলনায় ২৫ সেন্ট বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (ডব্লিউটিআই) ক্রুডের দামও ৭৫.১৪ ডলার পর্যন্ত বেড়েছে। যদিও দিনের শুরুতে দাম ২ শতাংশ কমে যাওয়ার পর আবার বিকেলের দিকে দাম বেড়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে দাম কিছুটা কমেছে, যেখানে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি ৭৬.৫৪ ডলারে নেমে এসেছে, কিন্তু ডব্লিউটিআই ক্রুডের দাম সামান্য বেড়ে ৭৫.২০ ডলারে উঠেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ওঠানামার কারণ হল যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের আশঙ্কা।
অর্থনীতিতে প্রভাব: সুদের হার ও জ্বালানি নীতি
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ সম্প্রতি সুদের হার অপরিবর্তিত রেখেছে, তবে ভবিষ্যতে ধীরে ধীরে কমানোর সম্ভাবনা রয়েছে। মার্কিন অর্থনীতিতে সুদের হার কমলে সাধারণত তেলের চাহিদা বৃদ্ধি পায়, যা তেলের দামের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কনীতি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিকে কিছুটা জটিল করে তুলেছে।
ফেডারেল রিজার্ভের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে মোট ০.৫০ শতাংশ সুদ কমানো হলেও পরবর্তী বছরগুলোতে কমানোর হার ধীরে ধীরে হ্রাস পাবে। এর ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জ্বালানি বাজারে কিছুটা স্থিতিশীলতা আসার প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের তেল মজুত হ্রাস, চাহিদা বৃদ্ধি?
যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি তথ্য প্রশাসনের (ইআইএ) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত সপ্তাহে দেশের অপরিশোধিত তেলের মজুত ১ কোটি ১৫ লাখ ব্যারেল কমে ৪২০.৯ মিলিয়ন ব্যারেলে নেমে এসেছে। বিশ্লেষকরা মজুত হ্রাসের এই প্রবণতাকে চাহিদার বৃদ্ধির সূচক হিসাবে দেখছেন, যা ভবিষ্যতে তেলের দামের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
গত কয়েক বছরে হামাস-ইসরায়েল সংঘাত, লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে হুতি বিদ্রোহীদের হামলা ইত্যাদি সত্ত্বেও তেলের দাম স্থিতিশীল বা কমে যাওয়ার কারণ ছিল মূলত চাহিদার অভাব। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বব্যাপী চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সরবরাহ ঝুঁকিও বাড়ায় তেলের দাম নতুন করে বাড়তে পারে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ
জাতিসংঘে নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে সরাসরি জড়িত হয়, তবে ইরান কঠোর জবাব দেবে। এই কথা বিশ্ব বাজারে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তেলের দাম আগামী কয়েক মাসে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে। যদি পরিস্থিতি শান্ত হয়, তাহলে দাম ৬৮ ডলারের নিচে নেমে আসতে পারে; আর যদি উত্তেজনা বাড়ে, তাহলে দাম ৮০ ডলারেরও বেশি পৌঁছাতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে অনিশ্চয়তা বিশ্ববাজারে তেলের দাম ওঠানামার প্রধান কারণ। বিশেষ করে হরমুজ প্রণালীতে সংঘাতের সম্ভাবনা ও তেলের সরবরাহ ঝুঁকি তেলের বাজারে ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে। তেলের দাম বৃদ্ধি পেলে বিশ্ব অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের জীবনে প্রভাব পড়া অস্বাভাবিক নয়।
এই পরিস্থিতিতে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগ নেওয়া ও কূটনৈতিক মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা জরুরি হয়ে উঠেছে। তেলমুখী অর্থনীতির ওপর বিশ্ব অর্থনীতির নির্ভরশীলতা বিবেচনা করে এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা একান্ত প্রয়োজন।