ইরানের আকাশসীমা আমরা পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছি: ট্রাম্প

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যকার চলমান উত্তেজনার মধ্যে নতুন করে আলোড়ন তুলেছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মঙ্গলবার (১৭ জুন) নিজের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক পোস্টে ট্রাম্প দাবি করেন, “ইরানের আকাশসীমার ওপর এখন আমাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।”
এই বক্তব্য বিশ্বজুড়ে কূটনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা এ খবর নিশ্চিত করেছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ নিয়ে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ট্রাম্পের দাবি: ‘আমরা’ কারা?
পোস্টে ট্রাম্প উল্লেখ করেন, “ইরানের কাছে ভালো মানের আকাশ পর্যবেক্ষণ যন্ত্র এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে, তবে সেগুলো আমাদের তৈরি প্রযুক্তির সঙ্গে তুলনীয় নয়।” যদিও এই বক্তব্যে ‘আমরা’ বলতে ট্রাম্প ঠিক কোন সংস্থাকে বা পক্ষকে বোঝাতে চেয়েছেন তা স্পষ্ট করেননি।
বিষয়টি আরও জটিল হয়েছে এ কারণে যে, মার্কিন সেনাবাহিনী এখনো ইরানের বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক পদক্ষেপের ঘোষণা দেয়নি। ফলে প্রশ্ন উঠছে, ট্রাম্প কি যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী, না কি ইসরায়েল বা ন্যাটো জোটের পক্ষের কোনো অভিযানে সমর্থন দিচ্ছেন?
আক্রমণ-প্রতিরোধে উত্তপ্ত তেহরান
এই পোস্ট দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইসরায়েলি বাহিনী তেহরান ও তার আশপাশে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে বলে জানা গেছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানায়, হামলায় অন্তত অর্ধশতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে, আহত হয়েছেন আরও বহু মানুষ।
ইরানি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, বেশ কয়েকটি ইসরায়েলি ড্রোন এবং ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করা হয়েছে। যদিও এই হামলায় গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কি না, সে বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি দেশটির কর্তৃপক্ষ।
পূর্বাভাস দিয়েছিলেন ট্রাম্প?
এর আগে সোমবার (১৬ জুন) আরেকটি পোস্টে ট্রাম্প ইঙ্গিতপূর্ণ হুঁশিয়ারি দেন। তিনি বলেন, “ইরানের উচিত ছিল অনেক আগেই পরমাণু চুক্তিতে পৌঁছানো।” একই সঙ্গে তিনি তেহরানের বাসিন্দাদের উদ্দেশে শহর ত্যাগের আহ্বান জানান।
তার এমন পোস্টের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্লেষকরা ধরে নেন যে, কিছু বড় ধরনের সামরিক অভিযান ঘটতে যাচ্ছে। এবং বাস্তবে তাই-ই ঘটেছে—ইসরায়েলের এয়ার স্ট্রাইক এই ইঙ্গিতকে দৃঢ় করে তোলে।
তবে ঠিক কোন সূত্র থেকে ট্রাম্প এমন তথ্য পাচ্ছেন বা তিনি এই সংঘাতে কী ধরনের ভূমিকা রাখছেন, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক কূটনীতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকে বলছেন, ২০২৪ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পরও ট্রাম্প এখনও মার্কিন প্রতিরক্ষা ও গোয়েন্দা মহলের কোনো অংশের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখতে পারছেন।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
চীন, রাশিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই ঘটনাগুলো নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং বলেছেন, “মধ্যপ্রাচ্যে হঠাৎ করে উত্তেজনা বৃদ্ধি আমাদের সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে।” একইসঙ্গে তিনি সকল পক্ষকে সংযত আচরণের আহ্বান জানান।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও এক বিবৃতিতে জানান, ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা দ্রুত প্রশমিত করা উচিত। অন্যথায় এটি মধ্যপ্রাচ্যকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলবে এবং সাধারণ মানুষের জীবনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে।
ইসরায়েলি জোটে মার্কিন সমর্থন?
বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের এই মন্তব্য হয়তো ইসরায়েলি হামলার একটি পরোক্ষ স্বীকৃতি। ইসরায়েল ইতোমধ্যে ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলো ধ্বংস করতে একাধিক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এ বিষয়ে তেলআভিভ বহুবার ইঙ্গিত দিয়েছে যে, তারা যেকোনো মূল্যে ইরানের পরমাণু কার্যক্রম থামাবে।
তবে ওয়াশিংটন এখনো সরাসরি এমন কোনো পদক্ষেপে অংশ নিচ্ছে কি না, তা অজানা। আবার অনেকেই বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো আকাশ পর্যবেক্ষণ বা সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্সে ইসরায়েলকে সহায়তা দিচ্ছে, যা ট্রাম্পের “আকাশসীমা নিয়ন্ত্রণে” থাকার বক্তব্যে প্রতিফলিত হতে পারে।
ইরান কী বলছে?
ইরানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ট্রাম্পের বক্তব্যকে ‘উস্কানিমূলক’ এবং ‘আন্তর্জাতিক আইন পরিপন্থী’ বলে মন্তব্য করেছে। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট যদি এমন মন্তব্য করেন, সেটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির জন্য অশুভ বার্তা বয়ে আনে।
তারা আরও জানায়, ইরান তার আকাশসীমা ও ভূখণ্ড রক্ষায় প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত। কেউ যদি ইরানের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করে, তাহলে তার জবাবও উপযুক্তভাবে দেওয়া হবে।
ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা
বিশ্ব কূটনৈতিক মহল এখন উদ্বিগ্ন—যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ শুরু হবে কি না। যদিও বাইডেন প্রশাসন এখন পর্যন্ত এই বিষয়গুলোতে সংযত বক্তব্য দিয়ে আসছে, তবে বাস্তবতা হলো—ইসরায়েল-ইরান সংঘাত ক্রমেই বড় পরিসরে রূপ নিচ্ছে।
আর এই প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পের মতো একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যদি ‘সম্পূর্ণ আকাশ নিয়ন্ত্রণের’ মতো বক্তব্য দেন, তবে সেটি মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে অস্থিরতা বাড়াবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, চলমান পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মহলের উচিত দ্রুত কূটনৈতিক সমাধানের পথ খুঁজে বের করা। কারণ সংঘাত যত দীর্ঘায়িত হবে, সাধারণ মানুষের ভোগান্তি তত বাড়বে।