ইসরায়েলি হামলায় ইরানে নিহত ৪৫০ ছাড়িয়েছে: মানবাধিকার সংস্থা

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাত নতুন করে রক্তক্ষয়ী রূপ নিয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস অ্যাকটিভিস্টস ইন ইরান (এইচআরএএনএ)-এর তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলি বাহিনীর ধারাবাহিক বিমান হামলায় ইরানে নিহতের সংখ্যা ৪৫০ ছাড়িয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত ৬৫০ জনের বেশি মানুষ।
এইচআরএএনএ জানিয়েছে, ১৩ জুন থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি বিমান হামলা ইরানের বিভিন্ন সামরিক, আধা-সামরিক এবং বেসামরিক এলাকায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। সংস্থাটি সংঘাত শুরুর প্রথম দিক থেকেই হতাহতের সংখ্যা নিরীক্ষণ করছে এবং তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এই ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
নিহত ও আহতের বিস্তারিত পরিসংখ্যান
এইচআরএএনএ-এর তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত নিহতদের মধ্যে রয়েছেন:
- ২২৪ জন বেসামরিক নাগরিক, যাঁরা মূলত সাধারণ বাসিন্দা, কর্মজীবী, নারী ও শিশু।
- ১০৯ জন সামরিক সদস্য, যাঁদের মধ্যে ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড ও নিয়মিত সেনাবাহিনীর সদস্যরাও রয়েছেন।
- ১১৯ জন অজ্ঞাতনামা নিহত ব্যক্তি, যাঁদের পরিচয় এখনো নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।
এছাড়া আহতদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৪৬ জনে। এর মধ্যে:
- ১৮৮ জন বেসামরিক নাগরিক,
- ১২৩ জন সামরিক সদস্য, এবং
- ৩৩৫ জন অজ্ঞাত পরিচয়ের আহত ব্যক্তি, যাঁরা গুরুতর অবস্থায় বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
হামলার ধরন ও লক্ষ্যবস্তু
হিউম্যান রাইটস অ্যাকটিভিস্টস ইন ইরান জানিয়েছে, ইসরায়েলের হামলা ছিল অত্যন্ত পরিকল্পিত ও লক্ষ্যভিত্তিক। প্রথমে সামরিক স্থাপনা ও পারমাণবিক গবেষণাকেন্দ্রগুলোতে হামলা চালানো হয়। এর পর পর্যায়ক্রমে বিমানঘাঁটি, কমিউনিকেশন সেন্টার, স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক ও রাডার স্টেশনগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসরায়েল কৌশলগতভাবে ইরানের সামরিক সক্ষমতা ধ্বংস করতে চাইছে। তবে এর প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের জীবনেও। হামলার কারণে বহু বাসাবাড়ি, স্কুল, হাসপাতাল, দোকানপাট ধ্বংস হয়েছে।
ইরানের পাল্টা প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েলি আগ্রাসনের জবাবে ইরানও ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ব্যাপক পাল্টা হামলা শুরু করেছে। ইরান দাবি করেছে, তারা ইসরায়েলের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত বেশ কয়েকটি সামরিক ঘাঁটি এবং রাডার সিস্টেম ধ্বংস করেছে।
ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেন, “আমাদের দেশের সার্বভৌমত্বে আঘাত হানলে, আমরা পাল্টা জবাব দিতে পিছপা হব না। আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনী সতর্ক এবং সক্রিয়।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধাবস্থা বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিশালী দেশগুলো যেমন সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতারসহ অনেকেই এই যুদ্ধ বন্ধে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করছে।
চীন ও রাশিয়া উভয় দেশ ইসরায়েলকে এই ধরণের উসকানিমূলক হামলা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, “এই সংঘাত গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল করতে পারে। শান্তিপূর্ণ সমাধানই একমাত্র উপায়।”
ইরানের রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়া
রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বা কর্তৃপক্ষ নিহতের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা প্রকাশ করেনি। তবে দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সম্প্রচারিত প্রতিবেদনগুলোতে বিভিন্ন এলাকায় বিমান হামলার দৃশ্য, ধ্বংস হওয়া ভবনের ছবি এবং আহত মানুষের করুণ আর্তনাদ তুলে ধরা হয়েছে।
ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি এক বিবৃতিতে বলেছেন, “আমরা আমাদের শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না। দখলদার শক্তির জবাব আমরা সর্বশক্তি দিয়ে দেব।”
মানবিক সংকট তীব্র হচ্ছে
যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে ইরানে এক মানবিক সংকটের আবির্ভাব ঘটেছে। বহু মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে শরণার্থী হিসেবে অন্য অঞ্চলে চলে গেছে। বিদ্যুৎ, পানি, খাদ্য সরবরাহ বিপর্যস্ত। হাসপাতালগুলো রোগীতে উপচে পড়ছে, ওষুধের সংকট তৈরি হয়েছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) জানিয়েছে, এই মুহূর্তে ইরানে জরুরি মানবিক সহায়তা পৌঁছানো দরকার। বিশেষ করে খাদ্য, ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রীর সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সংঘাত যদি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, তবে তা মধ্যপ্রাচ্যে এক পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। এর প্রভাব বিশ্ব জ্বালানি বাজারে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে সুদূরপ্রসারী হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্লেষক ডেভিড মার্টিন বলেন, “এই যুদ্ধ শুধু দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। এটি শিগগিরই আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রভাব ফেলবে। আন্তর্জাতিক মহলের তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপ এখন একান্ত প্রয়োজন।”
উপসংহার
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে নতুন করে অস্থিতিশীল করেছে। হিউম্যান রাইটস অ্যাকটিভিস্টস ইন ইরানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইতোমধ্যেই প্রাণ হারিয়েছেন ৪৫২ জন মানুষ, আহত হয়েছেন ৬৪৬ জন। সংঘাত চলতে থাকলে হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়বে—এটি নিশ্চিত। তাই এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং মানবিক সহায়তাই সবচেয়ে জরুরি।