খামেনির পরিণতি হতে পারে সাদ্দাম হোসেনের মতো, হুমকি ইসরায়েলের

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে লক্ষ্য করে চরম হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ। তিনি বলেছেন, খামেনির পরিণতিও হতে পারে ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের মতো—যিনি যুদ্ধাপরাধ ও আগ্রাসনের দায়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন।
ইসরায়েলের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের বরাতে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা এ তথ্য জানায়। সম্প্রতি ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার বাড়তে থাকা উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে কাৎজের এই বক্তব্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রীর হুঁশিয়ারি
ইসরায়েল কাৎজ তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘আমি ইরানের স্বৈরশাসককে স্পষ্টভাবে সতর্ক করছি—ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ, সন্ত্রাসে পৃষ্ঠপোষকতা এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা বন্ধ করুন। ইসরায়েলি নাগরিকদের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য আমরা সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইরানের প্রতিবেশী এক দেশের স্বৈরশাসক অতীতে একই পথে হেঁটেছিলেন। সেই পথের পরিণতি কী হয়েছিল, তা খামেনির স্মরণে রাখা উচিত। সাদ্দাম হোসেনের করুণ পরিণতি তাঁর জন্য একটি বড় শিক্ষা হতে পারে।’
প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এই বক্তব্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, ইসরায়েল প্রয়োজন হলে সামরিক উপায়ে ইরানের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে পারে। বিশেষ করে যখন ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সরাসরি সংঘাতের আশঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে, তখন এমন বক্তব্য পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করছে।
ইতিহাসের ছায়া টেনে হুঁশিয়ারি
২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনী সাদ্দাম হোসেনের ইরাকে হামলা চালায়। যুদ্ধের মাধ্যমে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এর কয়েক বছর পর, ২০০৬ সালে যুদ্ধাপরাধের দায়ে ইরাকের আদালতের রায়ে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এবং ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ইসরায়েল কাৎজ তাঁর বক্তব্যে এই ইতিহাস টেনেই খামেনিকে একই পরিণতির ইঙ্গিত দিয়েছেন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইসরায়েলের এই হুমকি কেবল retorics নয়—বরং এর পেছনে রয়েছে বাস্তব কৌশলগত বার্তা। ইসরায়েল এর আগেও ইরানের বিরুদ্ধে গোপন অভিযানের মাধ্যমে বিভিন্ন পরমাণু বিজ্ঞানী, সামরিক কর্মকর্তা ও সন্ত্রাসী সংগঠনের নেতাদের হত্যা করেছে বলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দাবি রয়েছে।
ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনার পটভূমি
২০২৫ সালে এসে ইরান ও ইসরায়েলের সম্পর্ক আরও বেশি বৈরী অবস্থায় পৌঁছেছে। গাজা, লেবানন ও সিরিয়ায় হিজবুল্লাহ, হামাস ও অন্যান্য গোষ্ঠীর সঙ্গে ইরানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ইসরায়েল এসব গোষ্ঠীকে তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে আসছে।
সম্প্রতি সিরিয়া ও ইরাকের বিভিন্ন এলাকায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) জ্যেষ্ঠ কমান্ডার নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে ইরান। পাল্টা প্রতিশোধের হুমকি দিয়ে ইরান সরাসরি ইসরায়েলি সামরিক ঘাঁটিগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর হুমকি দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রীর হুমকি দ্বিপক্ষীয় উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও সম্ভাব্য ফলাফল
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এই বক্তব্য কেবল ইরানের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি নয়, বরং পশ্চিমা মিত্রদের প্রতি এক ধরনের বার্তাও বটে—যেখানে ইসরায়েল দেখাতে চাইছে, যদি প্রয়োজন হয়, তারা এককভাবেও ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালাতে প্রস্তুত।
তবে বিষয়টি সহজ নয়। ইরান একদিকে যেমন একটি আঞ্চলিক পরাশক্তি, অন্যদিকে রাশিয়া ও চীনের মতো শক্তিধর মিত্রদের সমর্থনও তাদের রয়েছে। ফলে সরাসরি সংঘাত হলে এর প্রভাব শুধু মধ্যপ্রাচ্যে নয়, বৈশ্বিক রাজনীতিতেও মারাত্মক অভিঘাত ফেলতে পারে।
জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন উভয়ই ইতিমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছে। তারা সতর্ক করে বলেছে, এই অঞ্চলে সামান্য ভুল পদক্ষেপও পুরো বিশ্বকে এক অনাকাঙ্ক্ষিত সংঘাতের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
খামেনির অবস্থান
এই পরিস্থিতিতে আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি এখনও সরাসরি কোনো পাল্টা মন্তব্য করেননি। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টারা বলছেন, ইরান আত্মরক্ষার অধিকার রাখে এবং কোনো আগ্রাসনের জবাব ‘উপযুক্তভাবে’ দেওয়া হবে।
ইরানের প্রতিরক্ষা দপ্তর এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘ইসরায়েলকে আমরা হালকাভাবে নিচ্ছি না। যদি তারা ইরানের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করে, তাহলে তাদের ভেতরে ধ্বংসযজ্ঞ নেমে আসবে।’
উপসংহার
ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব নতুন মাত্রা পাচ্ছে। সাম্প্রতিক এই হুমকি-প্রতিহুমকি পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রীর খামেনিকে লক্ষ্য করে দেওয়া হুমকি আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনেও প্রবল আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিস্থিতি ক্রমেই এমন এক জায়গায় পৌঁছাচ্ছে, যেখানে যেকোনো একপক্ষের উসকানিমূলক পদক্ষেপ পুরো অঞ্চলে আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে। বিশ্ব পরাশক্তিগুলোর উচিত এখনই কূটনৈতিক উদ্যোগ জোরদার করে ইরান-ইসরায়েল বিরোধ নিরসনে কার্যকর ভূমিকা পালন করা।