ইসরায়েল-ইরান সংঘাত নিয়ে প্রথমবারের মতো মুখ খুললেন চীনের প্রেসিডেন্ট

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সামরিক উত্তেজনার প্রেক্ষিতে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং। তিনি বলেছেন, ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে মধ্যপ্রাচ্যে হঠাৎ করে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে, তা নিয়ে চীন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই সংকট সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
চীনের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সিনহুয়ার বরাতে সিএনএন-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কাজাখস্তানের রাজধানী আস্তানায় দ্বিতীয় চীন-মধ্য এশিয়া শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিতে গিয়ে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এই মন্তব্য করেন প্রেসিডেন্ট সি। তার সঙ্গে ওই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন উজবেকিস্তানের প্রেসিডেন্ট শাভকাত মিরজিয়োয়েভ।
চীন, বিশ্ব রাজনীতিতে এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর, বিশেষ করে ইরানের সঙ্গে দেশটির ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তেহরান-বেইজিং সম্পর্ক আরও মজবুত হয়েছে। এমন এক সময়ে চীনা প্রেসিডেন্টের এই বক্তব্য এল, যখন মধ্যপ্রাচ্য এক অনিশ্চয়তার দ্বারে উপনীত।
সি চিনপিং বলেন, “চীন সবসময়ই বিশ্বাস করে, অন্য কোনো দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা লঙ্ঘন করে এমন যেকোনো কর্মকাণ্ডের আমরা বিরোধিতা করি। সামরিক সংঘাত কোনো সমস্যার স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। এই অঞ্চলে উত্তেজনা বৃদ্ধি শুধু অঞ্চলটির নয়, বরং গোটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য উদ্বেগের কারণ।”
তিনি আরও বলেন, “বর্তমান সংঘাত অব্যাহত থাকলে তা কেবল ইরান বা ইসরায়েলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না; এর প্রভাব পড়বে পুরো মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্বজুড়ে। বিশেষ করে জ্বালানির বাজার, বাণিজ্য প্রবাহ ও মানবিক পরিস্থিতির ওপর এ সংঘাত ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।”
শান্তি ও সংলাপের পক্ষে চীনের অবস্থান
চীনের পররাষ্ট্রনীতি বরাবরই দ্বিপক্ষীয়তা, পারস্পরিক সম্মান ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংকটে মধ্যস্থতার ভূমিকা পালনের আগ্রহ সম্প্রতি আরও জোরালোভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
সি চিনপিং বলেন, “চীন প্রত্যাশা করে, সব পক্ষ দায়িত্বশীল আচরণ করবে এবং যত দ্রুত সম্ভব এই উত্তেজনা প্রশমনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। আমরা শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে গঠনমূলক ভূমিকা রাখার জন্য প্রস্তুত এবং প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী।”
উল্লেখ্য, সম্প্রতি ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে একাধিক সামরিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ইরানের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় ইসরায়েলি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পাশাপাশি ইরানও ইসরায়েলের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে পাল্টা হামলা চালিয়েছে বলে জানায় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো।
এই উত্তেজনার কারণে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনের মতো পরাশক্তি যখন স্পষ্টভাবে সংঘাতের বিরোধিতা করে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে কথা বলে, তখন তা কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে উৎসাহিত করতে পারে।
চীনের মধ্যপ্রাচ্য কৌশল
চীন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যে তার কৌশলগত প্রভাব বাড়িয়েছে। দেশটি একদিকে যেমন ইরানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্য ও নিরাপত্তা চুক্তি করেছে, অন্যদিকে সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গেও অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করছে।
২০২৩ সালে চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে কয়েক বছরের শীতল সম্পর্কের অবসান ঘটে। এ ঘটনাকে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহল একটি গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য হিসেবে দেখে। সে প্রেক্ষাপটে, ইরান-ইসরায়েল সংঘাতেও চীন একটি গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারী ভূমিকা রাখতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের একতরফা অবস্থান এবং ইসরায়েলপ্রীতি অনেক সময় মধ্যপ্রাচ্যের সংকট জটিল করে তোলে। সেখানে চীনের তুলনামূলক নিরপেক্ষ ভূমিকা শান্তিপ্রক্রিয়ায় একটি ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার পেছনে কারণ
গত কয়েক মাস ধরে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান উত্তেজনার উৎস মূলত গাজা পরিস্থিতি ও লেবাননে হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরায়েলের সংঘর্ষ। এছাড়া ইসরায়েলের ভেতরে ও বাইরে ইরানপন্থি গোষ্ঠীগুলোর ক্রমবর্ধমান সক্রিয়তাও এই উত্তেজনায় ভূমিকা রেখেছে।
ইসরায়েল দাবি করে, ইরান তার বিরুদ্ধে সরাসরি এবং পরোক্ষভাবে হামলা চালাচ্ছে। অপরদিকে, ইরান বলছে, ইসরায়েলই আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি এবং আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে একের পর এক আগ্রাসী পদক্ষেপ নিচ্ছে।
এই অবস্থায় চীনের মতো একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রকাশ্য শান্তির আহ্বান কূটনৈতিক সমীকরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনে দিতে পারে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
চীনের এ বক্তব্যের পরপরই রাশিয়া, তুরস্ক, ফ্রান্স ও ভারতসহ কয়েকটি দেশও ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা নিরসনে কূটনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, “এই ধরনের সংঘাত কোনো পক্ষেরই কল্যাণ বয়ে আনবে না। আমরা শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসনের পক্ষে।”
উপসংহার
ইসরায়েল-ইরান সামরিক উত্তেজনার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য আরও একবার অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংয়ের শান্তিপূর্ণ অবস্থান ও মধ্যস্থতার আগ্রহ শুধু কূটনৈতিকভাবে নয়, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত, সংঘাত নয় বরং আলোচনার মাধ্যমে এই সংকট নিরসনে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা। কারণ যুদ্ধ কেবল ধ্বংস ডেকে আনে, শান্তিই পারে ভবিষ্যতের জন্য স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে।