ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন, ইরানকে দোষারোপ জি-৭ জোটের

কানাডায় অনুষ্ঠিত ৫১তম জি-৭ শীর্ষ সম্মেলনে মধ্যপ্রাচ্যের চলমান অস্থিরতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশ্বের শীর্ষ সাতটি অর্থনৈতিক শক্তিধর দেশের নেতারা। গতকাল সোমবার রাতে দেওয়া এক যৌথ বিবৃতিতে তাঁরা সরাসরি ইরানকে দায়ী করেছেন মধ্যপ্রাচ্যে সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতার জন্য এবং একইসঙ্গে ইসরায়েলের প্রতি তাঁদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
বিবৃতিতে জোর দিয়ে বলা হয়, ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে এবং অঞ্চলটিতে চলমান উত্তেজনার জন্য ইরানকেই দায়ী করা উচিত। নেতারা আরও বলেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ভূমিকা রাখছে এবং এর ফলে অঞ্চলটির নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। জোটের নেতারা স্পষ্ট করেন, ইরানের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র কোনোভাবেই থাকা উচিত নয়।
সাম্প্রতিক হামলার প্রেক্ষাপট
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সাম্প্রতিক উত্তেজনা আরও বেড়েছে গত শুক্রবার ভোরে ইসরায়েলি ড্রোন হামলায় ইরানের কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তার নিহত হওয়ার পর। ওই ঘটনার জের ধরে দুদেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বিমান হামলা চলছে, যা ইতোমধ্যে সিরিয়া, লেবানন, ইরাকসহ আশপাশের দেশগুলোতেও উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
জি-৭ নেতাদের মতে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় শুরু হওয়া যুদ্ধ এক ধরনের সুপ্ত আগুনের জন্ম দিয়েছিল, আর ইসরায়েল-ইরানের এই সাম্প্রতিক সংঘর্ষ সেই আগুনে ঘি ঢালার মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
সম্মেলনের গৌণতা ও ট্রাম্পের আকস্মিক প্রস্থান
চলতি বছর কানাডার হ্যালিফ্যাক্সে অনুষ্ঠিত হয় ৫১তম জি-৭ সম্মেলন। তবে মধ্যপ্রাচ্যের উত্তাল পরিস্থিতির কারণে অন্যান্য আলোচ্য বিষয়গুলো অনেকটাই আড়ালে পড়ে যায়। আরও চমকপ্রদ বিষয় হলো, সম্মেলন শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্মেলন ছেড়ে ওয়াশিংটনে ফিরে যান।
ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, তিনি ‘গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণে’ দেশে ফিরছেন, যদিও তিনি যুদ্ধবিরতির সঙ্গে তাঁর ফিরে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেন। ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ালেও তিনি সম্মেলনের যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করে গেছেন।
ট্রাম্প-মাখোঁ দ্বন্দ্ব
ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ এ বিষয়ে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র এখন এমন একটি অবস্থানে রয়েছে, যেখান থেকে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত আলোচনা শুরু হতে পারে। যদি যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির কোনো উদ্যোগ নেয়, ফ্রান্স তা পুরোপুরি সমর্থন করবে।”
তবে ট্রাম্প মাখোঁর বক্তব্য খণ্ডন করে বলেন, “মাখোঁ জানেন না আমি কেন ফিরে যাচ্ছি। এটা কোনো যুদ্ধবিরতির কারণে নয়। এর চেয়েও অনেক বড় কোনো কারণ রয়েছে।”
এই পরিস্থিতি জি-৭ সম্মেলনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকেও সামনে এনে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষকেরা বলছেন, এতে পশ্চিমা দেশগুলোর ঐক্য নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে, বিশেষ করে যখন অঞ্চলজুড়ে সংঘাত বন্ধে কার্যকর সমাধান প্রয়োজন।
জি-৭-এর যৌথ বিবৃতি
সম্মেলন শেষে দেওয়া যৌথ বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, “আমরা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য দৃঢ়ভাবে আহ্বান জানাচ্ছি। ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আমরা সমর্থন করি এবং ইরানের সন্ত্রাসবাদে পৃষ্ঠপোষকতার নীতির বিরোধিতা করছি।”
জি-৭ নেতারা জানান, তাঁরা আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের রেজলুশন অনুযায়ী ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে চান এবং এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার (IAEA) ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
ইরান ও সমর্থক রাষ্ট্রগুলোর প্রতিক্রিয়া
জি-৭ জোটের বিবৃতির প্রতিক্রিয়ায় এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু না বললেও ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেছেন, “জি-৭ দেশগুলো ইসরায়েলের আগ্রাসনকে বৈধতা দিচ্ছে, যা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির বিপরীতে একটি হুমকি।”
এদিকে রাশিয়া ও চীন এই বিবৃতির নিন্দা করে বলেছে, “এই ধরনের পক্ষপাতমূলক বিবৃতি সংঘাত নিরসনের পরিবর্তে আরও উত্তেজনা বাড়িয়ে দিতে পারে।”
বিশেষজ্ঞ মত
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. সায়েদুল ইসলাম বলেন, “জি-৭-এর এ ধরনের একতরফা বিবৃতি মধ্যপ্রাচ্যের বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন। ইরানকে পুরোপুরি দোষারোপ করার মাধ্যমে তারা ইসরায়েলি আগ্রাসনকে উপেক্ষা করছে, যা ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে।”
তাঁর মতে, “বিশ্বশান্তির স্বার্থে এই বিবৃতিগুলোকে আরও ভারসাম্যপূর্ণ ও কূটনৈতিকভাবে সূক্ষ্মভাবে তৈরি করা উচিত।”
উপসংহার
জি-৭ সম্মেলনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মঞ্চে আবারও পশ্চিমা শক্তিগুলোর অবস্থান স্পষ্ট হয়েছে—তাঁরা ইরানকে আঞ্চলিক অস্থিরতার উৎস মনে করেন এবং ইসরায়েলের নিরাপত্তার প্রশ্নে একতাবদ্ধ। তবে সম্মেলন থেকে ট্রাম্পের আগেভাগে বিদায়, ফরাসি প্রেসিডেন্টের দ্বিমত, এবং রাশিয়া-চীনের বিরোধিতা স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিয়েছে—এই সংকটে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর অবস্থান একধরনের বিভক্তি নির্দেশ করে। ফলে, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা এখন শুধু কূটনৈতিক চাপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং দরকার কার্যকর রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও অংশগ্রহণমূলক সমাধান প্রক্রিয়া।