জাতিসংঘের পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি দিলো ইরান

মধ্যপ্রাচ্যের কূটনৈতিক মঞ্চে নতুন উত্তেজনার ইঙ্গিত দিচ্ছে ইরান। জাতিসংঘের পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি, ‘নন-প্রোলিফারেশন ট্রিটি (NPT)’ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছে তেহরান। এই ঘোষণার পর, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উদ্বেগ বেড়েছে কয়েক গুণ।
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইসমাইল বাঘাই সোমবার (১৬ জুন) তেহরানে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আমরা এনপিটি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছি। পার্লামেন্টে এর জন্য একটি বিল তৈরির কাজ চলছে এবং খুব শিগগিরই এ নিয়ে ভোটাভুটি হবে।”
ইসমাইল বাঘাই আরও বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের জাতীয় স্বার্থ এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। আইএইএ (IAEA) ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ এবং ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলা আমাদের এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করছে।”
পরমাণু চুক্তির পটভূমি
ইরান ১৯৭০ সালে জাতিসংঘের আওতায় গঠিত পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি (NPT)-তে স্বাক্ষর করে। সে সময় দেশটির শাসন ক্ষমতায় ছিলেন শাহ রেজা পাহলভী। এই চুক্তির আওতায় ইরান প্রতিশ্রুতি দেয় যে, তারা কখনো পরমাণু অস্ত্র তৈরি করবে না এবং আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থা IAEA-এর সঙ্গে স্বচ্ছতা বজায় রাখবে।
কিন্তু ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর নতুন শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতায় আসার পর পরমাণু কর্মসূচির প্রকৃতি এবং উদ্দেশ্য নিয়ে বিশ্বমহলে সংশয় দেখা দেয়। এরপর থেকে বিভিন্ন সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘ ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
সাম্প্রতিক উত্তেজনা: ইসরায়েল-ইরান সংঘাত
২০২৫ সালের জুন মাসের প্রথমার্ধে উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়, যখন ইসরায়েল তেহরানের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু হামলার পর জানান, “ইরান পরমাণু অস্ত্র নির্মাণের একেবারে দ্বারপ্রান্তে রয়েছে এবং এই বিপদ প্রতিহত করতেই আমরা আগাম পদক্ষেপ নিয়েছি।”
তবে ইরান এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেছেন, “ইরান কখনো পরমাণু অস্ত্র নির্মাণের পথে হাঁটবে না। এটি আমাদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির ফতোয়ার বিরোধী।” তিনি আরও বলেন, “আমাদের পরমাণু প্রকল্প সম্পূর্ণরূপে শান্তিপূর্ণ এবং গবেষণাভিত্তিক।”
IAEA-এর অভিযোগ ও পরিণতি
এর আগে গত সপ্তাহে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (IAEA) এক রেজোলুশনে দাবি করে যে, ইরান এনপিটি চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করেছে এবং IAEA-র পর্যবেক্ষণ দলকে পূর্ণ সহযোগিতা করছে না। এই অভিযোগকে কেন্দ্র করেই আন্তর্জাতিক মহলে চাপ বেড়ে যায় এবং ইসরায়েল তার সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
ইরান এই অভিযোগকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে IAEA-কে ইসরায়েলের সহায়তা করার অভিযোগ এনেছে। মুখপাত্র ইসমাইল বাঘাই বলেন, “IAEA তার নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। তাদের রেজোলুশনই ইসরায়েলকে আমাদের ওপর হামলা চালানোর সুযোগ করে দিয়েছে।”
পার্লামেন্টে বিল উত্থাপন
ইরানের জাতীয় সংসদ মজলিশে ইতোমধ্যে NPT থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য একটি বিল প্রস্তুত করা হচ্ছে। এই বিলের মাধ্যমে আইনতভাবে এনপিটি থেকে সরে আসার ভিত্তি তৈরি করা হবে। সংসদ সদস্যদের মধ্যে অনেকেই ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলার প্রেক্ষাপটে এ বিলের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন।
পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক কমিটির একজন সিনিয়র সদস্য বলেন, “আমরা আর আন্তর্জাতিক দায়িত্বের নামে আমাদের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলতে পারি না। এখন সময় এসেছে, ইরান কীভাবে তার জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ করবে তা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়ার।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ইরানের এমন হুমকির পর যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর এক বিবৃতিতে বলেছে, “NPT থেকে ইরানের সরে যাওয়া পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলবে। আমরা কূটনৈতিকভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছি।”
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সব পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যে ইতিমধ্যেই যে উত্তেজনা বিরাজ করছে, সেখানে নতুন করে পরমাণু উত্তেজনা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে।”
বিশেষজ্ঞদের মতামত
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ড. রুহুল আমিন বলেন, “ইরানের পক্ষ থেকে এনপিটি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি শুধু রাজনৈতিক কৌশলই নয়, এটি ভবিষ্যতের গ্লোবাল পরমাণু নিরাপত্তার জন্য একটি বড় হুমকি। ইসরায়েলের হামলা ও IAEA-র সমালোচনা ইরানকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচিত করেছে। তবে এটি পুরো বিশ্বব্যবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।”
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বর্তমানে ইরানের এই সিদ্ধান্ত শুধু তাদের জাতীয় নিরাপত্তার বিষয় নয়, এটি মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির দিক নির্দেশনাও দেবে। বিশ্লেষকদের মতে, ইরান যদি সত্যিই এনপিটি থেকে সরে আসে, তবে এ অঞ্চলে পরমাণু প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে। সৌদি আরব, তুরস্কসহ অন্যান্য দেশও নিজেদের পরমাণু কর্মসূচি সম্প্রসারণ করতে পারে।
উপসংহার
ইরান ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে চলমান উত্তেজনার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হচ্ছে, পরমাণু চুক্তির ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে। আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক শক্তিগুলোর উচিত এখনই কার্যকর সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা, নয়তো গোটা বিশ্বের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে।