বিশ্ব

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত বন্ধে মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত পুতিন-এরদোয়ান

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান উত্তেজনা ও পাল্টাপাল্টি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়িপ এরদোয়ান সংঘাত নিরসনে মধ্যস্থতার ভূমিকা পালনের জন্য প্রস্তুতি প্রকাশ করেছেন। গত চারদিন ধরে চলা এই সংঘাত বন্ধে উভয় নেতা আলাদাভাবে তাদের প্রতিশ্রুতি জানিয়েছেন, যা মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

সংঘাতের পটভূমি

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের সূত্রপাত ঘটে ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে, যখন ইসরায়েল সিরিয়ার দামেস্কে ইরানি দূতাবাসে হামলা চালায়। এই হামলায় বেশ কয়েকজন ইরানি জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নিহত হন। এর প্রতিশোধ হিসেবে ইরান ও তার মিত্ররা ১৩ এপ্রিল ইসরায়েলের অভ্যন্তরে হামলা চালায়। পরবর্তীতে ইসরায়েল ১৯ এপ্রিল ইরান ও সিরিয়ায় পাল্টা হামলা চালায়, যা উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনাকে আরও তীব্র করে। সর্বশেষ, ২০২৫ সালের ১৩ জুন ইসরায়েল ইরানের একাধিক স্থাপনায় হামলা চালায়, যার মধ্যে পারমাণবিক স্থাপনা এবং সামরিক ঘাঁটি অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই হামলায় ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) কমান্ডার হোসেইন সালামি, সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি এবং কয়েকজন পারমাণবিক বিজ্ঞানী নিহত হন। এই ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যে বৃহত্তর সংঘাতের আশঙ্কাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

পুতিনের মধ্যস্থতার প্রস্তাব

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এই সংঘাত নিরসনে মধ্যস্থতার ভূমিকা পালনের জন্য তার প্রস্তুতির কথা জানিয়েছেন। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, “রাশিয়ার পক্ষ থেকে সংঘাত নিরসনের জন্য আগের প্রস্তাব এখনও বহাল রয়েছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি আগের তুলনায় অনেক জটিল হয়ে পড়েছে।” তিনি আরও জানান, রাশিয়া বিবাদমান পক্ষগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে এবং কূটনৈতিক সমাধানের জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

রাশিয়ার এই উদ্যোগ ইরানের সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের কৌশলগত সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়া এবং ইরান ইউক্রেন সংঘাত এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ইস্যুতে একে অপরের ঘনিষ্ঠ মিত্র। তবে, ইসরায়েলের সঙ্গেও রাশিয়ার সম্পর্ক তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল। এই পরিস্থিতিতে পুতিনের মধ্যস্থতার প্রস্তাবকে অনেকে কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার একটি প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন। ক্রেমলিন আরও জানিয়েছে, রাশিয়া ইরানের অতিরিক্ত পারমাণবিক উপকরণ নিষ্পত্তির জন্য প্রস্তুত, যা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে উত্তেজনা কমাতে সহায়ক হতে পারে।

এরদোয়ানের কূটনৈতিক উদ্যোগ

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়িপ এরদোয়ানও ইরান-ইসরায়েল সংঘাত বন্ধে মধ্যস্থতার জন্য প্রস্তুতি প্রকাশ করেছেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, এরদোয়ান সোমবার ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। এই কথোপকথনে তিনি ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাত নিরসনে তুরস্কের মধ্যস্থতার ভূমিকা পালনের আগ্রহ প্রকাশ করেন। এরদোয়ান জানিয়েছেন, তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

তুরস্কের এই উদ্যোগ মধ্যপ্রাচ্যে তার ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বাড়ানোর কৌশলের অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। তুরস্ক ঐতিহাসিকভাবে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছে, যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসরায়েলের নীতির সমালোচনা করে আসছে। একই সঙ্গে, ইরানের সঙ্গে তুরস্কের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কও উল্লেখযোগ্য। এই দ্বৈত অবস্থান তুরস্ককে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারে।

সংঘাতের বৈশ্বিক প্রভাব

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার জন্য একটি গুরুতর হুমকি। এই সংঘাতের ফলে তেলের বৈশ্বিক সরবরাহ, বিশেষ করে হরমুজ প্রণালীর মতো কৌশলগত সমুদ্রপথের উপর প্রভাব পড়তে পারে। ইরান যদি এই সমুদ্রপথ বন্ধ করে দেয়, তবে বিশ্বব্যাপী তেল সরবরাহের প্রায় এক-চতুর্থাংশ স্থবির হয়ে পড়তে পারে, যা বিশ্ব অর্থনীতির জন্য মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনবে। এই সম্ভাবনার কারণে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো এই সংঘাত এড়াতে প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং জর্ডান ইতিমধ্যে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষায় অংশ নিয়েছে, যখন রাশিয়া এবং লেবাননের মতো দেশগুলো ইরানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এই উত্তেজনা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন।

পুতিন-এরদোয়ানের মধ্যস্থতার সম্ভাবনা

পুতিন এবং এরদোয়ানের মধ্যস্থতার প্রস্তাব মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। তবে, এই প্রক্রিয়া জটিল এবং চ্যালেঞ্জিং। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে দীর্ঘদিনের শত্রুতা এবং পারস্পরিক অবিশ্বাস এই মধ্যস্থতার পথে প্রধান বাধা। এছাড়া, রাশিয়া এবং তুরস্কের নিজস্ব ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ এই প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে।

বিশ্লেষকদের মতে, পুতিনের প্রস্তাব ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে উত্তেজনা কমানোর লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। অন্যদিকে, এরদোয়ানের উদ্যোগ তুরস্কের আঞ্চলিক প্রভাব বাড়ানোর কৌশলের অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে, উভয় নেতার প্রচেষ্টা সফল হওয়ার জন্য ইরান এবং ইসরায়েলের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক সমঝোতার ইচ্ছা অপরিহার্য।

উপসংহার

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত বন্ধে পুতিন এবং এরদোয়ানের মধ্যস্থতার প্রস্তাব মধ্যপ্রাচ্যের জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একটি আশার আলো। তবে, এই উদ্যোগের সাফল্য নির্ভর করবে বিবাদমান পক্ষগুলোর সহযোগিতা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনের উপর। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য এই মুহূর্তে কূটনৈতিক সমাধানই সবচেয়ে কার্যকর পন্থা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button