ইরান–ইসরায়েলের হামলা, পাল্টা হামলা: সর্বশেষ কী জানা গেল

ইরান-ইসরায়েলের উত্তপ্ত সংঘাত নতুন মাত্রা নিয়েছে। গত শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া এই সামরিক সংঘর্ষ এখনো থামেনি। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে হামলা আর পাল্টা হামলা অব্যাহত রয়েছে। দুই পক্ষই বড় ধরনের মানবিক ও ভৌত ক্ষতির মুখে পড়েছে। এই নিবন্ধে আমরা বিষয়টি বিস্তারিত ও সহজ বাংলা ভাষায় তুলে ধরেছি, যাতে পাঠকরা স্পষ্ট ও গভীরভাবে পরিস্থিতি বুঝতে পারেন।
ইরান-ইসরায়েলের সামরিক সংঘর্ষের পটভূমি
ইরান ও ইসরায়েলের সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই উত্তেজনাপূর্ণ। দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব বহু বছর ধরেই রয়েছে। সাম্প্রতিক হামলা ও পাল্টা হামলা এই দ্বন্দ্বকে আরও জটিল করে তুলেছে। ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি) ও ইসরায়েলের সেনাবাহিনী একে অপরের ওপর সামরিক ও গুপ্তহত্যার কার্যক্রম চালাচ্ছে।
গত ৭ দিনে সংঘটিত প্রধান ঘটনা
- ইরানের হামলা ও ইসরায়েলের হতাহতের খবর: ইরানের হামলায় গত রোববার রাতে ইসরায়েলের ভূখণ্ডে অন্তত ৪ জন নিহত হন। শুক্রবার থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলে নিহতের সংখ্যা পৌঁছেছে ১৯ জনে। ইসরায়েলের জাতীয় জরুরি পরিষেবা এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।
- ইরানের ক্ষয়ক্ষতি: ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলের প্রতিপক্ষ হামলায় দেশজুড়ে এখন পর্যন্ত ২২৪ জন নিহত হয়েছেন। এতে সামরিক কর্মকর্তাদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
- তেহরানে আইআরজিসি সদর দপ্তরে হামলা: ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানায়, তেহরানে কুদস ফোর্সের প্রধান কার্যালয়ে তারা হামলা চালিয়েছে। এতে ইরানের তিন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছেন গোয়েন্দা শাখার প্রধান মোহাম্মদ কাজেমি।
- হাইফা বন্দরে আগুন: ইরানের নতুন ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলের বন্দরনগরী হাইফায় দুটি বিস্ফোরণ ঘটেছে। দুই ব্যক্তি আহত হয়েছেন, তিনজন এখনও নিখোঁজ। যুক্তরাজ্যের সামুদ্রিক নিরাপত্তা সংস্থা অ্যামব্রে জানিয়েছে, বন্দরের কাছাকাছি একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে আগুন লেগেছে।
- মধ্য ইরানে বিমান হামলা: ইসরায়েলি সেনাবাহিনী মধ্য ইরানে একাধিক বিমান হামলা চালিয়েছে। লক্ষ্যবস্তু ছিল ক্ষেপণাস্ত্র ও সামরিক স্থাপনা। আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই হামলা ইরানের সামরিক অবকাঠামোতে বড় ধরনের ক্ষতি করেছে।
রাজনৈতিক বিবৃতি ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
- ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য: গিদিয়ন সার, ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্পষ্ট করেছেন যে তাদের সরকারের লক্ষ্য ইরানের শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তন করা নয়। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমাদের লক্ষ্য কেবল নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।”
- ইরানের যুদ্ধবিরতি অস্বীকার: ইরান যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনার জন্য কোনো প্রস্তুতি নেয়ার কথা জানিয়েছে না। মধ্যস্থতাকারী কাতার ও ওমানকে জানানো হয়েছে, যুদ্ধবিরতি নিয়ে এখনো তেহরান রাজি নয়।
- ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্বেগ: ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন বলেছেন, “ইরানের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র থাকা প্রশ্নাতীতভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।” তিনি এই বিষয় নিয়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে একমত হয়েছেন।
সামরিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষণ
এই সংঘর্ষ ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে দীর্ঘদিনের অবিশ্বাস ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ফল। ইরান মধ্যপ্রাচ্যের এক শক্তিশালী দেশ হিসেবে নিজের প্রভাব বৃদ্ধি করতে চায়। ইসরায়েল এই প্রভাব বৃদ্ধিকে প্রতিহত করতে চায়, কারণ এটি নিজেকে পরিবেষ্টিত মনে করে শত্রু দেশ দ্বারা। সাম্প্রতিক হামলা ও পাল্টা হামলা মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি করেছে, যার ফলে বিশ্বজুড়ে নিরাপত্তার উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
সামরিক বিশেষজ্ঞদের মতামত
বিশ্বের সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংঘর্ষ যে কোনও সময় বড় আকারে বিস্তৃত যুদ্ধের রূপ নিতে পারে। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি উন্নত হলেও ইসরায়েলের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অত্যাধুনিক, তাই সরাসরি যুদ্ধ আরও জটিল ও ধীরগতিতে চলছে। তবে সামরিক ঘাঁটাঘাঁটি, গুপ্তহত্যা এবং হাই-টেক সামরিক হামলা এই যুদ্ধের মূল বৈশিষ্ট্য।
মানবিক প্রভাব ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি
এই সংঘর্ষে হাজারো সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইরানের ও ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে বোমা বিস্ফোরণ, ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ও বিমানবাহিনীর গুলিতে বহু পরিবার পরিবার ভেঙে পড়েছে। পালিয়ে যাওয়া শরণার্থীদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া, বিদ্যুৎ ও পানীয় জলের সংকট তৈরি হয়েছে।
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা ও আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা
বর্তমানে কাতার ও ওমান যুদ্ধবিরতি এবং শান্তি আলোচনা চালানোর জন্য মধ্যস্থতা করছে। তবে, ইরানের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতির জন্য কোনো প্রস্তাবে সম্মতি না দেওয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব নেতারা এই সংঘর্ষে সহনশীলতা এবং পরবর্তী বড় ধরনের সংঘর্ষ এড়াতে দ্রুত কূটনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানাচ্ছেন
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার সাম্প্রতিক সামরিক সংঘর্ষ মধ্যপ্রাচ্যের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে। যুদ্ধ, গুপ্তহত্যা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে চলা এই খেলা কেবল সামরিক তৎপরতা নয়, বরং দুই দেশের গভীর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিবাদের প্রতিফলন।
বিশ্ব সম্প্রদায়ের উচিত এই সংকট থেকে দ্রুত সমাধান খুঁজে বের করা, যাতে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।