রাশিয়া থেকে ইউক্রেনকে ফেরত গেল ১২০০ জন সৈন্যের মরদেহ

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের মধ্যে গত তিন বছরে সবচেয়ে বড় মরদেহ প্রত্যাবর্তনের ঘটনা ঘটেছে। রাশিয়া সম্প্রতি ইউক্রেনকে ১,২০০ জন ইউক্রেনীয় সৈন্যের মরদেহ হস্তান্তর করেছে। এই খবর নিশ্চিত করেছে কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা, যা রুশ সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে প্রকাশ করেছে।
গতকাল (১৩ জুন) স্থানীয় সময় রাশিয়া থেকে ইউক্রেনকে এসব মরদেহ হস্তান্তর করা হয়। এটি যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সবচেয়ে বড় সংখ্যক মৃত সৈন্যের মরদেহ প্রত্যাবর্তন।
ইস্তাম্বুল শান্তি আলোচনার পর সেনাদের মরদেহ ফেরত
গত মাসে ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত রাশিয়া ও ইউক্রেনের শান্তি আলোচনার পর এই মরদেহ ফেরতের ঘটনা ঘটল। আলোচনায় এক বিশেষ চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধবন্দী ও নিহত সৈন্যদের মরদেহ বিনিময় নিয়ে কিছু সমঝোতা হয়েছিল। তবে মস্কো দাবি করেছে, এই মরদেহ হস্তান্তর একতরফা পদক্ষেপ ছিল। রাশিয়া অভিযোগ করেছে, ইউক্রেন এখন পর্যন্ত তাদের নিহত সৈন্যদের মরদেহ ফিরিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা ‘তাস’-এর অজ্ঞাত সূত্র জানিয়েছে, “রাশিয়া ইউক্রেনীয় সশস্ত্র বাহিনীর ১২০০ জন নিহত সৈন্যের মরদেহ ফেরত দিয়েছে, কিন্তু আমাদের কাছে এখনো একটিও মরদেহ আসেনি।”
ইউক্রেনের পক্ষের উত্তর: ফরেনসিক যাচাই চলছে
ইউক্রেনের যুদ্ধবন্দী বিষয়ক সদর দফতর শুক্রবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, প্রাপ্ত মরদেহগুলো ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা শনাক্ত করার কাজ শুরু করেছেন। তারা আশা প্রকাশ করেছেন, এগুলো ইউক্রেনীয় সৈন্যদের মরদেহই হবে।
ইউক্রেন আরও জানায়, চলতি সপ্তাহের শুরুতে রাশিয়া ১,২১৩টি মরদেহ ফেরত দেয়, বিনিময়ে ইউক্রেন ২৭ জন রুশ সৈন্যের মরদেহ দিয়েছে।
যুদ্ধবন্দী ও নিহত সৈন্যদের বিনিময়ে সম্মতি
যুদ্ধের উত্তেজনার মধ্যেও, দুই পক্ষ নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে প্রায় ৬,০০০ জন নিহত সৈন্য ও যুদ্ধবন্দীর বিনিময়ে। এই বিনিময়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে গুরুতর অসুস্থ, আহত ও ২৫ বছরের নিচের বন্দীদের মুক্তির।
রাশিয়া ও ইউক্রেনের মাঝে বন্দী ও মৃতদেহ বিনিময় যুদ্ধের মাঝে মানবিক যোগাযোগ রক্ষা করার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
যুদ্ধ অব্যাহত: ফ্রন্টলাইনে তীব্র সংঘাত ও নতুন হতাহত
অন্যদিকে, যুদ্ধের তীব্রতা কমেনি। শুক্রবারও ইউক্রেন ও রাশিয়ার ফ্রন্টলাইনে তীব্র লড়াই চলছে। দুই পক্ষ থেকেই নতুন নতুন হতাহতের খবর পাওয়া যাচ্ছে।
রাশিয়ার বেলগোরোদ অঞ্চলে ইউক্রেনীয় ড্রোন হামলায় দুই বছরের এক শিশু নিহত হয়েছে। এছাড়া শিশুটির দাদিসহ দুই প্রাপ্তবয়স্কও আহত হয়েছেন। এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন বেলগোরোদের গভর্নর ভ্যাচেস্লাভ গ্লাদকভ।
রাশিয়ার ড্রোন প্রতিরোধ ও ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসের দাবি
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় তারা ২৬০টি ইউক্রেনীয় ড্রোন প্রতিহত করেছে। এছাড়াও, গত সপ্তাহে রাশিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষা বাহিনী বেশ কিছু উচ্চ প্রযুক্তির অস্ত্র ও ড্রোন ধ্বংস করেছে।
তাদের দাবি অনুযায়ী, তারা একটি নেপচুন দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, ১৮টি জেডিএএম গাইডেড বোমা, ৯টি মার্কিন তৈরি হিমার্স রকেট এবং ১,৫৮২টি ইউক্রেনীয় ফিক্সড-উইং ড্রোন ভূপাতিত করেছে।
বিশ্লেষণ: মানবিক সংকট ও যুদ্ধের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব
তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা এই যুদ্ধ ইউক্রেনের মানুষের জীবনে মর্মান্তিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। হাজার হাজার পরিবার এখনো তাদের স্বজনদের মরদেহ না পেয়ে বসে আছে।
মরদেহ প্রত্যাবর্তন যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি ও বিনিময়ের প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এতে সামরিক এবং মানবিক দিক থেকে দুই দেশের মাঝে কিছুটা সংযোগ বজায় থাকে।
তবে যুদ্ধের তীব্রতা এবং নিয়মিত সংঘাত অব্যাহত থাকায় প্রতিটি যুদ্ধবন্দী ও নিহত সৈন্যের মরদেহের বিনিময় পুরোপুরি নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে উঠেছে।
সাম্প্রতিক যুদ্ধের পটভূমি
২০১৯ সালের পর থেকেই ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত চরম আকার ধারণ করেছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার ব্যাপক আগ্রাসনের পর থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে বড় ধরণের পরিবর্তন এসেছে। আন্তর্জাতিক মহল যুদ্ধ বন্ধে বহু শান্তি উদ্যোগ নিয়েছে, তবে স্থায়ী সমাধান এখনও সম্ভব হয়নি।
এই সময়ে ইউক্রেনের শহরগুলোতে ব্যাপক ধ্বংস-স্তুপ ও লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়েছেন। বহু দেশের মধ্যে থেকে অস্ত্র ও মানবিক সহায়তা আসলেও যুদ্ধের অবস্থা ক্রমেই তীব্রতর হচ্ছে।
কী আশা করা যায়?
সাম্প্রতিক মরদেহ ফেরত দেয়ার ঘটনা শান্তির সম্ভাবনা বাড়াতে পারে। আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুই পক্ষই মানবিক প্রয়োজনে কিছুটা নমনীয়তা দেখাচ্ছে।
তবে যুদ্ধ এখনও থামেনি, যুদ্ধের আগুন এখনও জ্বলছে ফ্রন্টলাইনে। এই কঠিন পরিস্থিতিতে মানবাধিকার রক্ষা এবং যুদ্ধবন্দীদের নিরাপদ মুক্তি নিশ্চিত করাই এখন সময়ের দাবি।
সারসংক্ষেপ
- রাশিয়া ইউক্রেনকে ১২০০ জন সৈন্যের মরদেহ ফেরত দিয়েছে, যা তিন বছরের যুদ্ধে সবচেয়ে বড় মৃতদেহ প্রত্যাবর্তন।
- ইস্তাম্বুলে শান্তি আলোচনার পর মরদেহ হস্তান্তরের ঘটনা ঘটল।
- ইউক্রেন ফরেনসিকভাবে মরদেহ শনাক্তকরণ শুরু করেছে।
- দুই পক্ষ ৬০০০ জন নিহত ও যুদ্ধবন্দীর বিনিময়ে নীতিগত সম্মত।
- ফ্রন্টলাইনে এখনও তীব্র লড়াই ও নতুন হতাহতের খবর পাওয়া যাচ্ছে।
- রাশিয়া দাবি করছে ব্যাপক ইউক্রেনীয় ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করেছে।