ইসরায়েলের হামলায় ইরানের সেনাপ্রধানসহ ২০ সামরিক কমান্ডার নিহত

ইসরায়েলের বিমান হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক কেন্দ্র
১৩ জুন ২০২৫, তেহরান ও জেরুজালেম থেকে — ইসরায়েলের ভয়াবহ বিমান হামলায় ইরানের রাজধানী তেহরানসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। হামলায় ইরানের সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল বাঘেরি সহ অন্তত ২০ জন ঊর্ধ্বতন সামরিক কমান্ডার নিহত হয়েছেন। এর পাশাপাশি পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র, ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনকেন্দ্র এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও ব্যাপকভাবে ধ্বংস হয়েছে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বলছে, তাদের এই ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামক অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রকল্প এবং সামরিক সক্ষমতা নাশ করা।
ইসরায়েলের বিমান হামলা: ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ ও হতাহতের খবর
হামলা শুরু হয় বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে তিনটায়, যখন প্রায় ২০০টি ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান দেশটির বিভিন্ন অংশে আক্রমণ চালায়। তেহরানের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলসহ অন্তত আটটি শহরে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। নাতাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনা লক্ষ্য করে ধ্বংসাত্মক হামলা চালানো হয়, যেখানে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ এবং পারমাণবিক গবেষণার কাজ চলছিল।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, “বিস্ফোরণের শব্দে আমাদের ঘুম ভেঙে যায়, আতঙ্কে সবাই ঘর থেকে বের হয়ে আসে। শিশুরা কাঁদছিল, আমরা নিরাপত্তা নিয়ে ব্যাপক শঙ্কায় রয়েছি।” স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, হামলায় ৭৮ জন নিহত ও ৩২৯ জন আহত হয়েছে, যাদের মধ্যে রয়েছে ছয়জন পরমাণুবিজ্ঞানী।
ইরানের সেনাপ্রধানসহ ঊর্ধ্বতন কমান্ডারদের মৃত্যুর শোক
ইরানের ইসলামি রেভোলিউশনারি গার্ড কোর (IRGC) জানিয়েছে, তাদের প্রধান কার্যালয় তেহরানে হামলার সময় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এতে বাহিনীর প্রধান হোসেইন সালামি এবং বিমান বাহিনীর কমান্ডার আমির আলী হাজিজাদেহ নিহত হন। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন জানায়, সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল বাঘেরিও প্রাণ হারিয়েছেন।
রয়টার্সের সূত্র মতে, ইসরায়েলের বিমান হামলায় অন্তত ২০ জন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন।
ইরানের পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, তেল আবিবে আতঙ্ক
ইসরায়েলের হামলার জবাবে ইরান শুক্রবার রাতে শত শত ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেট ছুড়েছে তেল আবিবসহ ইসরায়েলের বিভিন্ন এলাকায়। আকাশে ধোঁয়া ও সাইরেনের শব্দে উত্তেজনা বাড়ে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বলেছে, তারা এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলাগুলো প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছে, তবে অন্তত ১৫ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি এবং প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান হামলার পর কঠোর ভাষায় বলেছিলেন, ইসরায়েলকে এর জন্য কঠিন মূল্য দিতে হবে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা
ইরান-ইসরায়েলের পুরনো শত্রুতা নতুন মাত্রা পেলো এই হামলার মাধ্যমে। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক ক্রমাগত উত্তপ্ত। ২০২৩ সালের গাজার সংঘাতের পর থেকে উত্তেজনা আরও বেড়েছে।
এই হামলার পর, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস দ্রুত সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার নিন্দা করেছেন এবং উভয় পক্ষকে শান্তি বজায় রাখতে বলছেন। পাশাপাশি রাশিয়া, চীন, জর্ডান, ওমান, কাতার ও যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য দেশও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ও সতর্কতা
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র, যদিও সরাসরি হামলায় যুক্ত ছিল না, তবে হামলার পূর্বেই ইসরায়েলের পরিকল্পনা সম্পর্কে ওয়াশিংটন অবগত ছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র এই হামলায় কোনো সরাসরি অংশগ্রহণ করেনি, তবে তারা ইসরায়েলের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রস্তুত।
যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে বড় সংঘর্ষের আশঙ্কা করেছিল এবং তাদের দূতাবাস থেকে কূটনীতিকদের সরিয়ে নিয়েছিল। ইরানের সঙ্গে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সীমিতকরণের আলোচনা রোববার হওয়ার কথা ছিল, তবে হামলার পর তা বাতিল হয়েছে।
ইসরায়েলের প্রস্তুতি ও সামরিক মোতায়েন
ইসরায়েল সেনাপ্রধান আইয়াল জামির বলেছেন, তারা দেশের চারদিকে ১০ হাজারের বেশি সৈন্য মোতায়েন করেছে এবং সর্বোচ্চ সতর্কতায় রয়েছে। তিনি সতর্ক করে বলেন, “যে কেউ আমাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে, তাকে বড় মূল্য দিতে হবে।” তিনি এও জানিয়েছেন, ইরানের হামলার পাল্টা ব্যবস্থা নিতে তারা দীর্ঘদিন ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ
ইরান-ইসরায়েলের দ্বন্দ্ব বহু দশকের পুরনো। ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর থেকে দুই দেশের মধ্যে পারমাণবিক সক্ষমতা, ভূরাজনৈতিক আধিপত্য এবং মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে লড়াই চলছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই শত্রুতা আরও তীব্র হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক হামলা ও পাল্টা হামলার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের সংঘর্ষের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবিলম্বে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে শান্তি প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে, অন্যথায় পুরো অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে পড়তে পারে।
ইসরায়েল ও ইরানের সাম্প্রিক এই তীব্র সংঘর্ষ মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা, সামরিক সংঘাত এবং ভূ-রাজনৈতিক টানাপোড়েন এ অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতার কারণ হতে পারে। আন্তর্জাতিক মহল ও বিশেষত জাতিসংঘকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে নতুন যুদ্ধের সঙ্কেত রোধ করা যায় এবং মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।