ইসরায়েলের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ ইরানের, তেল আবিবে বিস্ফোরণ–ধোঁয়ার কুণ্ডলী

মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে উত্তেজনা আবারও চরমে উঠেছে। ইরান থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে ইসরায়েল। তেহরানের দাবি অনুযায়ী, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘প্রতিরোধমূলক প্রতিশোধ’ হিসেবে তারা কয়েক শ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। এরইমধ্যে ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিবে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে এবং শহরের আকাশে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা গেছে।
আক্রমণের প্রকৃতি ও প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর বিবৃতি অনুযায়ী, তারা ইরান থেকে নিক্ষিপ্ত একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করেছে এবং সেগুলোর বেশিরভাগকেই আকাশেই লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে। তবে কিছু ক্ষেপণাস্ত্র তেল আবিব এবং আশপাশের এলাকায় বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে বলেও জানা গেছে।
রাত আনুমানিক ১১টার দিকে তেল আবিব ও জেরুজালেমে একযোগে সাইরেন বেজে ওঠে, যার পরপরই কয়েক দফা বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। এতে আতঙ্কে লোকজন সুরক্ষিত আশ্রয়ে পালাতে শুরু করে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জনগণকে ঘরের ভেতর থাকার এবং নিরাপদ বাঙ্কারে আশ্রয় নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও এবং ছবি থেকে দেখা গেছে, তেল আবিবের বিভিন্ন এলাকায় কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠে আসছে এবং জরুরি সেবা কর্মীরা ঘটনাস্থলে ছুটে যাচ্ছেন।
ইরানের অবস্থান ও ঘোষণা
ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তা সংস্থা ‘ইরনা’ দাবি করেছে, ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলার জবাবে তারা “সীমিত পরিসরের সামরিক প্রতিক্রিয়া” শুরু করেছে। বার্তা সংস্থাটি জানিয়েছে, ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে কয়েক শ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে এবং হামলা চলমান রয়েছে।
তেহরানের এক সামরিক মুখপাত্র বলেন, “আমরা ইসরায়েলি আগ্রাসনের যথোপযুক্ত জবাব দিচ্ছি। এটি আত্মরক্ষার অধিকার, এবং যতক্ষণ না নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে, প্রতিক্রিয়া চলবে।”
পূর্বপ্রেক্ষাপট: ইসরায়েলের হামলা ও উত্তেজনার সূত্রপাত
ইরানের এই হামলা ইসরায়েলের একাধিক সামরিক অভিযানের প্রতিক্রিয়া বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর আগে ইসরায়েল গোপন ড্রোন হামলার মাধ্যমে তেহরানে একটি সামরিক গবেষণা কেন্দ্রে বিস্ফোরণ ঘটায় বলে অভিযোগ উঠে।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে উভয় দেশের মধ্যে সাইবার হামলা, গোপন অভিযানে হত্যা এবং সীমান্তবর্তী এলাকায় গুলিবিনিময়ের ঘটনা বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে ইরানের সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা মধ্যপ্রাচ্যকে যুদ্ধের কিনারায় নিয়ে গেছে বলে বিশেষজ্ঞদের মত।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও উদ্বেগ
ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনার প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তর জানায়, তারা পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সকল পক্ষকে “তাত্ক্ষণিক সংযম” প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “মধ্যপ্রাচ্য এখন জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির ওপর বসে আছে। এমন উত্তেজনা বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি।”
ইসরায়েলি প্রতিশোধের আশঙ্কা
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়াভ গালান্ত জানিয়েছেন, “ইরানের হামলা সহ্য করা হবে না। আমরা আমাদের ভূখণ্ড ও জনগণের রক্ষা করব, প্রয়োজনে কঠোর প্রতিশোধ নেওয়া হবে।”
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জরুরি নিরাপত্তা বৈঠক ডেকেছেন। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ইসরায়েলও পাল্টা হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
অধিবাসীদের ভয় ও আতঙ্ক
তেল আবিবের এক বাসিন্দা রয়টার্সকে জানান, “সাইরেন বাজার পরপরই আমি বাচ্চাদের নিয়ে নিচতলায় আশ্রয় নিই। কয়েক সেকেন্ড পর বিশাল শব্দ শুনি, বাড়ি কেঁপে উঠেছিল।”
তেল আবিবের হাসপাতালগুলোতে জরুরি পরিস্থিতি জারি করা হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, কয়েকজন আহত অবস্থায় হাসপাতালে আসেন, যাঁদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধও রয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরণের সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র বিনিময় বিগত দশকের মধ্যে অন্যতম বড় সামরিক সংঘর্ষের দিকে ইঙ্গিত করছে। ইরান ও ইসরায়েল উভয় দেশই আঞ্চলিকভাবে সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী, এবং এই দ্বন্দ্ব গোটা অঞ্চলকে অস্থির করে তুলতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক রবার্ট ম্যালি বলেন, “এই সংঘর্ষ যদি আরও বিস্তৃত আকার ধারণ করে, তাহলে লেবানন, সিরিয়া, ইরাক এমনকি সৌদি আরব পর্যন্ত টেনে আনা হতে পারে। এতে করে একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।”
উপসংহার
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার এই সর্বশেষ উত্তেজনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও বিশ্বশান্তি রক্ষার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ এখন সময়ের দাবি।
বর্তমানে ইসরায়েল তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেছে এবং জনগণকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার আহ্বান জানিয়েছে। তবে বড় প্রশ্ন হলো, এই সংঘর্ষ কোথায় গিয়ে থামবে? বিশ্ব এখন উদ্বেগভরে তাকিয়ে আছে মধ্যপ্রাচ্যের দিগন্তে—আকাশে উড়তে থাকা ধোঁয়ার কুণ্ডলীর পেছনে লুকিয়ে থাকা সম্ভাব্য আরও বড় ধ্বংসযজ্ঞের আশঙ্কায়।