ইরানের বিরুদ্ধে একতরফা হামলার চিন্তায় ইসরায়েল

ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে ইসরায়েল ইরানের বিরুদ্ধে একতরফা সামরিক হামলার পরিকল্পনা করছে বলে জানা গেছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনবিসি পাঁচটি সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, আমেরিকার সমর্থন ছাড়াই এই হামলা হতে পারে। ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান পরমাণু আলোচনায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সংক্রান্ত কিছু শর্ত ইসরায়েলের কাছে গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ও সামরিক গতিপথকে নতুন করে প্রভাবিত করতে পারে।
পরমাণু আলোচনা ও ইসরায়েলের উদ্বেগ
ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পরমাণু চুক্তি নিয়ে আলোচনা দীর্ঘদিন ধরে চলছে। ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন (জেসিপিওএ) থেকে ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে যাওয়ার পর ইরান তার পরমাণু কর্মসূচি ত্বরান্বিত করেছে। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জানিয়েছে, ইরান তার পরমাণু বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করছে, বিশেষ করে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের ক্ষেত্রে। আইএইএ’র তথ্য অনুযায়ী, ইরান উচ্চমাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে, যা পরমাণু অস্ত্র তৈরির সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তুলছে। এই পরিস্থিতি ইসরায়েলের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে নিজেদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে আসছে। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বারবার বলে আসছেন যে, তারা কোনোভাবেই ইরানকে পরমাণু অস্ত্র তৈরির সুযোগ দেবে না। এনবিসি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরানের সঙ্গে আমেরিকার চলমান আলোচনায় কিছু শর্ত ইসরায়েলের কাছে অগ্রহণযোগ্য। বিশেষ করে, ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাত্রা এবং পরিমাণ নিয়ে ইসরায়েলের তীব্র আপত্তি রয়েছে। এই অবস্থায় ইসরায়েল একতরফা হামলার মাধ্যমে ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোতে আঘাত হানার পরিকল্পনা করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আমেরিকার অবস্থান ও ট্রাম্পের ভূমিকা
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানকে পরমাণু চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য সময়সীমা দিয়েছিলেন। কিন্তু তেহরান এই শর্ত মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, যা ট্রাম্পকে অসন্তুষ্ট করেছে। এনবিসি’র সূত্র অনুযায়ী, ট্রাম্প ইসরায়েলের একতরফা পদক্ষেপে হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে। আমেরিকান থিঙ্কট্যাঙ্ক ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের মাইকেল নাইটস বলেন, ইরাকে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস থেকে কর্মীদের সরিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তেহরানকে এই বার্তা দিচ্ছে যে, তারা ইসরায়েলের পদক্ষেপে বাধা দেবে না।
এদিকে, ইসরায়েলের সম্ভাব্য হামলার আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য ও আশপাশের অঞ্চলে অবস্থিত তাদের দূতাবাসগুলোতে সতর্কতা জারি করেছে। অপ্রয়োজনীয় কর্মীদের সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। এই পদক্ষেপ ইঙ্গিত দেয় যে, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পাল্টা প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা সম্পর্কে সতর্ক রয়েছে। মার্কিন কর্মকর্তারা এবং তাদের মিত্ররা এই পরিস্থিতিতে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
ইরানের প্রতিক্রিয়া ও আঞ্চলিক প্রভাব
ইরান বারবার বলে আসছে যে, তাদের পরমাণু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে। তবে আইএইএ’র প্রতিবেদন এবং ইসরায়েল ও পশ্চিমা দেশগুলোর অভিযোগ এই দাবির বিপরীতে যায়। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বারবার হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো হামলা হলে তারা পাল্টা জবাব দেবে। ইরানের সমর্থিত হিজবুল্লাহ এবং হুথি গোষ্ঠীর মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ইতিমধ্যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামলা চালিয়েছে, যা মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
ইসরায়েলের সম্ভাব্য একতরফা হামলা মধ্যপ্রাচ্যে বৃহত্তর সংঘাতের সূচনা করতে পারে। ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু আলোচনা ব্যর্থ হলে এবং ইসরায়েল হামলা চালালে, এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই পরিস্থিতি তেলের বাজার, বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েলের সম্ভাব্য হামলার খবরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। জাতিসংঘ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বারবার উভয় পক্ষকে সংযমী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। তবে ইসরায়েলের কঠোর অবস্থান এবং ইরানের পাল্টা হুমকি এই আহ্বানকে জটিল করে তুলছে। এদিকে, রাশিয়া এবং চীনের মতো দেশগুলো ইরানের পক্ষে তাদের সমর্থন অব্যাহত রেখেছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
উপসংহার
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে ইসরায়েলের উদ্বেগ এবং সম্ভাব্য একতরফা হামলার পরিকল্পনা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ও সামরিক পরিস্থিতিকে নতুন মোড় দিতে পারে। আমেরিকার নিরপেক্ষ অবস্থান এবং ইরানের পাল্টা প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা এই উত্তেজনাকে আরও তীব্র করছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখন সংযম এবং কূটনৈতিক সমাধানের পথ খুঁজছে, তবে পরিস্থিতির অনিশ্চয়তা বৈশ্বিক মঞ্চে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।