কুংফুর প্যাচে মিলল ৪৩ কোটি বছর পুরোনো মাছের পূর্ণাঙ্গ ফসিল

চীনের চংকিং প্রদেশের এক পাহাড়ি অঞ্চলে ২০১৯ সালের এক সন্ধ্যাবেলায় ঘটে যায় এক ঐতিহাসিক ঘটনা, যা আধুনিক জীবাশ্মবিজ্ঞানের ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ঘটনাটি ছিল অপ্রত্যাশিত, এমনকি খানিকটা কৌতুকপূর্ণও। কাজের ফাঁকে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তিনজন জীবাশ্মবিদ। তাদের মাঝে হালকা কুংফু প্রদর্শনের একপর্যায়ে একজন আরেকজনকে একটি পাথরের ঢিবির ওপর ফেলে দেন। প্রথমে বিষয়টি নিছক দুর্ঘটনা বলেই মনে হয়েছিল। তবে, যে পাথরের ওপর ধাক্কা খেয়ে পড়েছিলেন সেই গবেষক, তার ভারে ভেঙে যায় পাথরের ঢিবিটি—আর বেরিয়ে আসে এক দুর্লভ ও যুগান্তকারী আবিষ্কার: ৪৩ কোটি বছর পুরোনো এক পূর্ণাঙ্গ জ্য ফিশের ফসিল।
প্রাগৈতিহাসিক যুগের সাক্ষী এই জীবাশ্ম
এই অনন্য ফসিলটি ছিল একটি শক্ত চোয়ালবিশিষ্ট মাছের, যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় “জ্য ফিশ” (Jawed Fish) বলা হয়। পূর্বে এমন প্রাচীন মাছের ফসিল আংশিক পাওয়া গেলেও, এটাই ছিল প্রথম সম্পূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ জীবাশ্ম।
ডিসকভারি নিউজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই আবিষ্কৃত জীবাশ্মটি ‘সিলুরিয়ান যুগ’-এর শুরুর দিককার, যার বয়স অনুমান করা হয়েছে প্রায় ৪৩ কোটি বছর। কার্বন ডেটিং পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, এটি পূর্বে আবিষ্কৃত যে কোনো মাছের জীবাশ্মের চেয়ে অন্তত ১ কোটি ১০ লাখ বছর পুরোনো। ফলে, এই ফসিল প্রাণীজগতের বিবর্তনের ধারা বিশ্লেষণে এক যুগান্তকারী উপাত্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
জীবাশ্মবিদদের আবেগ ও গবেষণা
চীনের পেকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট জীবাশ্মবিদ ঝু মিন, যিনি এই আবিষ্কার ঘিরে প্রকাশিত চারটি গবেষণাপত্রের একটি দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন,
“এটি স্বপ্নপূরণের মতো। আমাদের চোখের সামনে এখন যে মাছটি রয়েছে, তা শুধু প্রাচীন নয়—এর ভেতর লুকিয়ে আছে সমুদ্রজগতের বিবর্তনের সূচনা।”
তিনি আরও যোগ করেন,
“এত নিখুঁতভাবে সংরক্ষিত কোনো জ্য ফিশের ফসিল এর আগে বিজ্ঞানীরা দেখেননি। এটি আমাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে জলজ প্রাণীদের বিকাশ ও তাদের শারীরিক গঠনের ধারা নিয়ে।”
কেমন ছিল এই প্রাচীন মাছটি?
এই জীবাশ্মটি প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার দীর্ঘ এবং এতে পরিস্কারভাবে দেখা যায় চোয়াল, কশেরুকা, পাখনা ও খুলি। মাছটির দেহগঠন এমনভাবে সংরক্ষিত যে, আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে স্ক্যান করে সহজেই তার অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিশ্লেষণ করা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর জৈব গঠন প্রমাণ করে যে শক্ত চোয়ালযুক্ত জলজ প্রাণীরা বিবর্তনের ইতিহাসে আরও আগেই অস্তিত্ব লাভ করেছিল, যা পূর্বের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করছে।
বৈজ্ঞানিক মহলে প্রতিক্রিয়া
এখন পর্যন্ত হাঙরকে বিবর্তনের প্রথম জ্য ফিশের উদাহরণ হিসেবে ধরা হত, কারণ ৪৩ কোটি বছর আগের এক হাঙরের জীবাশ্মে চোয়ালের আংশিক চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু এই নতুন আবিষ্কৃত ফসিলটি সম্পূর্ণ এবং আরও পুরোনো। ফলে, বিজ্ঞানীরা বলছেন, জ্য ফিশের বিবর্তনের ইতিহাস এখন আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
চীনে ফসিল খোঁজার নতুন দিগন্ত
চংকিং প্রদেশের পাশাপাশি কাছাকাছি গুইঝো অঞ্চলটিও ফসিল অনুসন্ধানের জন্য বিখ্যাত। এখানে ইতিমধ্যে বহু প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। তবে, এই পূর্ণাঙ্গ জ্য ফিশের ফসিল প্রাপ্তির ফলে চংকিং অঞ্চল নতুন করে জীবাশ্মবিজ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে। বিজ্ঞানীরা আশাবাদী, এ অঞ্চল থেকে ভবিষ্যতেও আরও অনেক প্রাচীন জীবাশ্ম পাওয়া যেতে পারে।
পরবর্তী গবেষণার দিকনির্দেশনা
বিশেষজ্ঞ দল বলছেন, এই মাছের ডিএনএ বিশ্লেষণ করা সম্ভব না হলেও এর হাড় ও দেহ গঠনের মাধ্যমে অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে এর আত্মীয়তার যোগসূত্র খুঁজে বের করা যাবে। এটি শুধু মাছ নয়, সরীসৃপ, উভচর, এমনকি স্তন্যপায়ীদের বিবর্তন বিশ্লেষণেও সহায়ক হতে পারে।
শেষ কথা
একটি অনিচ্ছাকৃত কুংফু প্যাঁচ এবং তার ফলস্বরূপ আবিষ্কৃত একটি আশ্চর্যজনক জীবাশ্ম—এই ঘটনাই প্রমাণ করে দেয়, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান কেবল কঠোর গবেষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, কখনো কখনো দুর্ঘটনাই ইতিহাস রচনা করে। ৪৩ কোটি বছর পুরোনো জ্য ফিশের এই আবিষ্কার নতুন করে প্রাণীবিজ্ঞানের পাঠ বদলে দিতে পারে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।