জন্মহার হ্রাস পাচ্ছে, ২ সন্তান নীতি বাতিল করল ভিয়েতনাম

কমিউনিস্ট শাসিত ভিয়েতনাম চার দশক ধরে কার্যকর থাকা ‘দুই সন্তান নীতি’ বাতিল করেছে। ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকা জন্মহারের প্রেক্ষাপটে ২০২৫ সালের ৪ জুন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে এই নীতি বাতিলের ঘোষণা দেয়। রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তাসংস্থা ভিয়েতনাম নিউজ এজেন্সি এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
এই পদক্ষেপ দেশটির ভবিষ্যৎ জনসংখ্যা কাঠামোর জন্য একটি বড় রূপান্তর হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কারণ কমে আসা জন্মহার নিয়ে গত কয়েক বছর ধরেই উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছিল স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো।
ইতিহাসের পটভূমি
১৯৮০ সালে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য চীন ‘এক সন্তান নীতি’ চালু করে। এর আট বছর পর, ১৯৮৮ সালে ভিয়েতনাম তার নিজস্ব সংস্কৃতিগত ও সামাজিক বাস্তবতা বিবেচনায় ‘দুই সন্তান নীতি’ প্রণয়ন করে। এই নীতির আওতায় সরকারি চাকরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধায় প্রাধান্য পেত এমন পরিবার, যাদের দুই বা তার কম সন্তান ছিল।
তবে সেই সময়ের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা আর এখনকার পরিস্থিতি এক নয়। বর্তমানে ভিয়েতনামের সরকার এই নীতি বাতিল করে সকল দম্পতিকে পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা দিয়েছে।
কমছে জন্মহার, বাড়ছে উদ্বেগ
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, গত তিন বছরে ভিয়েতনামে জন্মহারের ধারাবাহিক পতন ঘটেছে। ২০২২ সালে যেখানে জন্মহার ছিল ২.১, ২০২৩ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১.৯৬ এবং ২০২৪ সালে আরও হ্রাস পেয়ে হয়েছে ১.৯১। এটি এমন একটি স্তর, যা জনসংখ্যা টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম মাত্রার নিচে পড়ে যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি কোনো দেশে জন্মহার দীর্ঘদিন ধরে কমতে থাকে, তাহলে সেখানে তরুণ জনসংখ্যা হ্রাস পায় এবং বয়স্ক নাগরিকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এ অবস্থা অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা, সামাজিক নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব
জন্মহার হ্রাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ভিয়েতনামের সামাজিক সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক চাপ। সংস্কৃতিগতভাবে ছেলে সন্তানের প্রতি গুরুত্ব বেশি থাকায় অনেক দম্পতি কন্যাসন্তান জন্মে নিরুৎসাহিত হন। ফলে নারী-পুরুষের অনুপাতে ভারসাম্যহীনতা দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে দেশটিতে প্রতি ১০০ জন মেয়েশিশুর বিপরীতে রয়েছে ১১২ জন ছেলেশিশু।
এই প্রবণতা দীর্ঘমেয়াদে আরও ভয়াবহ সামাজিক সমস্যা তৈরি করতে পারে। যেমন— বিয়ের উপযুক্ত বয়সে মেয়েদের ঘাটতি, পুরুষদের মধ্যে হতাশা বৃদ্ধি এবং সামাজিক অস্থিরতা।
তরুণ প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে
ভিয়েতনামের তরুণ প্রজন্ম দিনকে দিন বিয়ে ও সন্তানধারণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। রাজধানী হ্যানয়ে কর্মরত ২২ বছর বয়সী ত্রান মিন হুয়ং এএফপিকে জানান, তার ভবিষ্যতে সন্তান নেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই। তিনি বলেন, ‘‘আজকের দিনে একটি শিশুকে বড় করে তোলা শুধুই আবেগ নয়, এটি একটি বিশাল ব্যয়বহুল দায়িত্ব।’’
তরুণদের এই মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছে সরকারের উচ্চপর্যায়ে। সম্প্রতি একটি সংবাদ সম্মেলনে ভিয়েতনামের স্বাস্থ্যমন্ত্রী এনগুয়েন থি লিয়েন ও স্বীকার করেন যে, তরুণ সমাজ সন্তান নেওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে। তিনি তাদের উদ্দেশ্যে আহ্বান জানিয়েছেন যেন তারা পরিবার গঠনে আগ্রহ দেখায়।
নীতির ব্যর্থতা এবং ভবিষ্যতের করণীয়
অবশ্য শুধু আহ্বানেই পরিস্থিতির উন্নয়ন হবে না—এমনটি মনে করেন অনেক বিশ্লেষক। হুওং থি ওয়ান নামে ৪৫ বছর বয়সী এক নারী, যিনি তিন সন্তানের জননী, বলেন, ‘‘আমি সরকারের দুই সন্তান নীতির সময়ই তিন সন্তান নিয়েছিলাম। তবে এটা সত্যি, একজন শিশুকে বড় করতে ভিয়েতনামে যে খরচ হয়, তা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘সরকার যদি সত্যিকারের পরিবর্তন চায়, তাহলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর জন্য আর্থিক প্রণোদনা ও সহায়তা চালু করতে হবে।’’
বিশেষজ্ঞদের মতে, নীতির পুনর্মূল্যায়ন এবং দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খুঁজে বের করতে হলে শুধুমাত্র সন্তানধারণের স্বাধীনতা প্রদান যথেষ্ট নয়। বরং সরকারকে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে সন্তান লালন-পালন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও তুলনা
ভিয়েতনামের বর্তমান পরিস্থিতি অনেকটা চীনের সঙ্গে তুলনীয়। চীন ২০১৫ সালে ‘এক সন্তান নীতি’ তুলে দেয় এবং পরবর্তীতে ২০২১ সালে ‘তিন সন্তান নীতি’ চালু করে। যদিও এসব পরিবর্তনের পরেও চীনে জন্মহার আশানুরূপ বাড়েনি। একই ধরনের পরিস্থিতি দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও সিঙ্গাপুরেও দেখা যাচ্ছে, যেখানে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি এবং কর্মজীবন কেন্দ্রিক সংস্কৃতি সন্তান নেওয়ার প্রবণতা কমিয়ে দিয়েছে।
উপসংহার
ভিয়েতনামের ‘দুই সন্তান নীতি’ বাতিল নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। তবে এটি একা জন্মহারে পরিবর্তন আনবে—এমন আশাবাদ এখনও সুদূরপরাহত। তরুণ প্রজন্মের মানসিকতা, আর্থসামাজিক চাহিদা, কর্মজীবন এবং ভবিষ্যতের নিরাপত্তা সব মিলিয়ে এমন একটি জটিল বাস্তবতার সৃষ্টি হয়েছে, যেটি নীতিগত পদক্ষেপ ছাড়াও গভীর সামাজিক সংস্কার ও অর্থনৈতিক সহায়তার দাবি রাখে।
ভিয়েতনামের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ হলো— কেবল নীতি বদল নয়, বরং একটি সমন্বিত, দীর্ঘমেয়াদি ও জনমুখী কর্মসূচির মাধ্যমে জনসংখ্যা কাঠামোকে ভারসাম্যপূর্ণ রাখা।