বিশ্ব

ইউক্রেনকে এক লাখ ড্রোন দিচ্ছে যুক্তরাজ্য

ইউক্রেনকে সহায়তা হিসেবে এক লাখ ড্রোন সরবরাহ করার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাজ্য। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা দপ্তরের বরাতে এ তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই ড্রোনগুলো ২০২৬ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যে ইউক্রেনের হাতে পৌঁছে দেওয়া হবে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই সংখ্যাটি পূর্বের প্রতিশ্রুতির তুলনায় দশ গুণ বেশি।

যুক্তরাজ্যের এই পদক্ষেপ শুধু ইউক্রেনকে আরও শক্তিশালী করে তোলার মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি বড় কৌশলগত বার্তাও বহন করছে—রাশিয়ার মতো পরাশক্তিকে প্রতিরোধ করতে হলে প্রযুক্তিনির্ভর ও উচ্চতর আক্রমণাত্মক সামরিক সক্ষমতা অপরিহার্য।

ড্রোন যুদ্ধের নতুন অধ্যায়

ব্রিটিশ সরকারের ভাষ্যমতে, এই মানববিহীন উড়োযানগুলো যুদ্ধের প্রচলিত ধারা সম্পূর্ণরূপে বদলে দিয়েছে। ড্রোন প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার যুদ্ধক্ষেত্রে গতি এনেছে, শত্রুর উপর নিরব ও নির্ভুল আঘাত হানার সুযোগ তৈরি করেছে এবং রণকৌশলে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে, যেখানে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী প্রায় প্রতিদিনই রাশিয়ার সুশৃঙ্খল বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে, সেখানে এই ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর অস্ত্র সিস্টেম তাদের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বহুগুণে বাড়াবে।

কৌশলগত প্রতিরক্ষা পর্যালোচনার প্রতিফলন

এই সহায়তার ঘোষণা এসেছে এমন এক সময়ে, যখন যুক্তরাজ্য তাদের নতুন কৌশলগত প্রতিরক্ষা পর্যালোচনার (Strategic Defence Review) সুপারিশ বাস্তবায়নের পথে রয়েছে। পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে জয়লাভ করতে হলে একটি শক্তিশালী, প্রযুক্তিনির্ভর এবং আক্রমণাত্মক সামরিক বাহিনী গড়ে তোলা অপরিহার্য।

ড্রোনসহ অন্যান্য প্রযুক্তিনির্ভর অস্ত্র ব্যবস্থার ওপর গুরুত্বারোপ করে ব্রিটেন বলেছে, ভবিষ্যতের যুদ্ধে বিজয়ের জন্য এসব প্রযুক্তি অপরিহার্য উপাদান হয়ে উঠেছে।

ব্রাসেলসে ইউক্রেন ডিফেন্স কন্টাক্ট গ্রুপের বৈঠক

যুক্তরাজ্য এবং জার্মানির যৌথ আয়োজনে ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত ইউক্রেন ডিফেন্স কন্টাক্ট গ্রুপের বৈঠকে এই ঘোষণা দেওয়া হয়। বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশের প্রতিনিধিত্বে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে, ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও দৃঢ় করতে পশ্চিমা মিত্রদের মধ্যে নতুন করে সমন্বয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

বৈঠকে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী জন হিলি জানান, শুধু ড্রোন নয়, ২০২৫ সালের মধ্যেই যুক্তরাজ্য ইউক্রেনকে ১ লাখ ৪০ হাজার গোলাবারুদ সরবরাহ সম্পন্ন করেছে। এছাড়া, ইউক্রেনীয় সেনাদের প্রশিক্ষণের জন্য ২৪৭ মিলিয়ন পাউন্ড ব্যয়ে একটি বড় প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে।

৩৫০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের ড্রোন প্যাকেজ

ড্রোন সহায়তার এই বিশাল প্যাকেজের আর্থিক মূল্য ধরা হয়েছে ৩৫০ মিলিয়ন পাউন্ড, যা ব্রিটেনের ঘোষিত ৪.৫ বিলিয়ন পাউন্ডের সামরিক সহায়তা পরিকল্পনার অংশ। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইউক্রেনের অন্যতম বড় মিত্র হিসেবে ব্রিটেন নিয়মিত সামরিক, মানবিক এবং প্রশিক্ষণ সহায়তা দিয়ে আসছে।

বিশেষ করে ইউক্রেনের জন্য সরবরাহকৃত অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে লং-রেঞ্জ ক্ষেপণাস্ত্র, ট্যাঙ্ক, বিমান বিধ্বংসী অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং স্যাটেলাইট ভিত্তিক নজরদারি সিস্টেম। নতুন ড্রোন প্যাকেজটিকে এসবেরই একটি কার্যকর সংযোজন হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ব্রিটেনের ভূমিকায় নতুন মাত্রা

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যুক্তরাজ্যের এই সিদ্ধান্ত শুধু ইউক্রেনের জন্যই নয়, বরং গোটা ইউরোপের নিরাপত্তা কাঠামোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। এই সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে, ইউরোপে যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমা শক্তিগুলো আরও সংহত এবং প্রতিরোধমূলক হয়ে উঠছে।

এছাড়া, যুক্তরাজ্য ইউক্রেনকে সহায়তার মাধ্যমে নিজেদের সামরিক শিল্পকে আধুনিকীকরণ এবং আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতেও আগ্রহী।

ড্রোন প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ ও যুদ্ধক্ষেত্রে প্রভাব

বিশ্বজুড়ে ড্রোন প্রযুক্তির বিকাশ সামরিক কৌশলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। এগুলো কম খরচে, দ্রুত এবং কার্যকরভাবে শত্রুপক্ষকে আঘাত হানতে সক্ষম। বিশেষ করে ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতে ড্রোন ব্যবহার এক ধরনের “ডিজিটাল যুদ্ধ” সৃষ্টি করেছে, যেখানে সেনারা মাঠে না নামলেও দূর থেকে শত্রুর ওপর সুনির্দিষ্ট আঘাত হানতে পারছে।

এই প্রযুক্তির প্রভাব এতটাই সুস্পষ্ট যে, অনেক দেশই এখন নিজেদের অস্ত্রভাণ্ডারকে ড্রোন এবং প্রযুক্তিনির্ভর যুদ্ধ উপযোগী করে তুলছে।

উপসংহার

যুক্তরাজ্যের এই এক লাখ ড্রোন সহায়তার ঘোষণা একদিকে যেমন ইউক্রেনের সামরিক সক্ষমতা জোরদারে নতুন অধ্যায় সূচিত করবে, তেমনি বিশ্বরাজনীতিতে প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিরক্ষা কৌশলের বাস্তবতা ও প্রাসঙ্গিকতা নতুন করে সামনে আনবে। এই পদক্ষেপ ইউক্রেনের যুদ্ধ জয়ের পথে একটি বড় সহায়ক শক্তি হিসেবে বিবেচিত হবে বলে বিশ্লেষকদের অভিমত।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button