বিশ্ব

বেঙ্গালুরুর শিরোপা উৎসবে পদপিষ্ট হয়ে ১১ জনের মৃত্যু

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে আইপিএলের ১৮তম আসরে শিরোপার স্বাদ পেয়েছে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু (আরসিবি)। রুদ্ধশ্বাস ফাইনালে পাঞ্জাব কিংসকে ৬ রানে হারিয়ে প্রথমবারের মতো ট্রফি জয়ের আনন্দে মাতোয়ারা হয়েছিল গোটা বেঙ্গালুরু শহর। কিন্তু সেই বিজয়ের মুহূর্তই অচিরেই পরিণত হলো ভয়াবহ বিপর্যয়ে। ট্রফি উদযাপন উপলক্ষে চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামের বাইরে ভিড় জমায় হাজারো সমর্থক। অতিরিক্ত ভিড় ও নিরাপত্তা ঘাটতির ফলে সৃষ্টি হয় বিশৃঙ্খলা। পদপিষ্ট হয়ে প্রাণ হারান অন্তত ১১ জন, আহত হন আরও অন্তত ২৫ জন, যাদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

উল্লাস থেকে হাহাকার: কীভাবে ঘটলো এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা?

ম্যাচের পরদিন সকাল থেকেই শহরে ছিল উৎসবের আমেজ। আরসিবি দলটির দীর্ঘ ১৭ বছরের অপেক্ষার পর পাওয়া এই প্রথম শিরোপা, স্বাভাবিকভাবেই তা রূপ নেয় গণআন্দোলনের মতো এক আনন্দ মিছিলে। টিম আরসিবি যখন হোম গ্রাউন্ড চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে ট্রফি নিয়ে ফেরে, তখন স্টেডিয়ামের বাইরে কয়েক হাজার সমর্থক একত্র হন তাদের প্রিয় দলের এক ঝলক দেখার আশায়।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সকাল থেকে ভিড় বাড়তে থাকে। তবে দুপুরের দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। দর্শকদের চাপে গেট ভেঙে পড়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। একপর্যায়ে সংঘটিত হয় ভয়াবহ পদপিষ্টের ঘটনা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, অনেকেই মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে তাদের কেউ উঠতে পারেননি। শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যু হয় বেশ কয়েকজনের।

আহতদের অবস্থা গুরুতর, নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে

পুলিশ ও দমকল বাহিনীর তৎপরতায় আহতদের তড়িঘড়ি করে উদ্ধার করে স্থানীয় বোরিং হাসপাতাল ও বৈদী হাসপাতালে পাঠানো হয়। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, আহতদের মধ্যে কয়েকজনের শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। ইতিমধ্যেই মৃতের সংখ্যা ১১ তে পৌঁছেছে। স্থানীয় প্রশাসন আশঙ্কা করছে, সংখ্যাটি আরও বাড়তে পারে।

নিরাপত্তা ব্যর্থতা ও প্রশাসনের দায়

এই দুর্ঘটনার পরই উঠেছে প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রশ্ন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া এক বিবৃতিতে বলেন, “অত্যধিক ভিড় ছিল। জনতা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। আমরা জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার সময় পাইনি।” তিনি আরও জানান, পরিস্থিতি বিবেচনা করে আরসিবির ওপেন বাস প্যারেড কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে। খেলোয়াড়দের নিয়ে সাধারণ বাসে স্টেডিয়ামে আনা হয়।

উপ-মুখ্যমন্ত্রী ডি কে শিবকুমার জানান, “আমরা ৫ হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েন করেছিলাম। কিন্তু এত উচ্ছ্বসিত জনতার মাঝে লাঠিচার্জের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারিনি।” তিনি আরও বলেন, “এমন উল্লাসে আমাদের প্রস্তুতি পর্যাপ্ত ছিল না, সেটি এখন স্পষ্ট।”

আরসিবি খেলোয়াড়দের নিরাপত্তা ও বিমানবন্দর থেকে স্টেডিয়ামে যাত্রা

হিন্দুস্থান অ্যারোনটিক্স লিমিটেডের (HAL) বিমানবন্দরে অবতরণ করে আরসিবি দল। সেখানেই দলকে স্বাগত জানাতে যান উপ-মুখ্যমন্ত্রী ডি কে শিবকুমার সহ মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য। তবে বিপুল ভিড়ের কারণে দলের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দেয়। তড়িঘড়ি করে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক ডাকা হয় যেখানে মুখ্যমন্ত্রী, উপ-মুখ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

রাজনৈতিক বিরোধ ও দায় চাপানোর পালা

এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার রেশ ছড়িয়ে পড়েছে রাজ্য রাজনীতিতেও। কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে বিরোধী দল বিজেপি। বিজেপি নেতা অমিত মালব্য এক্স-এ (সাবেক টুইটার) ক্ষোভ প্রকাশ করে লেখেন, “এই ট্র্যাজেডি কোনো দুর্ঘটনা নয়, বরং কংগ্রেস সরকারের অপরাধমূলক গাফিলতির ফল। সরকার রক্তাক্ত হয়েছে সাধারণ মানুষের রক্তে। এতগুলি প্রাণ হারালো শুধুমাত্র দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণে।”

এই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে কংগ্রেস মুখপাত্র পাল্টা জবাবে বলেন, “বিজেপি এই ট্র্যাজেডিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানাতে চাইছে। এখন আমাদের প্রয়োজন দোষীদের খুঁজে বের করা ও আহতদের পাশে দাঁড়ানো।”

সোশ্যাল মিডিয়ায় শোকপ্রকাশ ও ক্ষোভ

ঘটনার পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে নিহতদের ছবি ও ভিডিও। অনেকেই আরসিবি দলের পক্ষ থেকে দুঃখপ্রকাশের আবেদন জানান। টিম ক্যাপ্টেন বিরাট কোহলিও এক্সে শোক প্রকাশ করে লেখেন, “আমাদের এই জয় অনেক কষ্টে এসেছে, কিন্তু এই শোক আমাদের আনন্দকে ম্লান করে দিয়েছে। আমরা নিহতদের পরিবারের পাশে রয়েছি।”

ভবিষ্যতের করণীয় ও তদন্ত

রাজ্য সরকার ইতিমধ্যেই একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, “এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হবে এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” প্রশাসনও জানিয়েছে, ভবিষ্যতে এমন গণজমায়েতের জন্য আরও পরিকল্পিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

উপসংহার

আরসিবির বহু কাঙ্ক্ষিত শিরোপা জয় স্মরণীয় হওয়ার কথা ছিল পুরো দক্ষিণ ভারতের জন্য। কিন্তু তার পরিবর্তে সেই স্মৃতি হয়ে উঠলো দুঃখ ও মৃত্যুতে ভরা। প্রশ্ন উঠছে, এমন এক জয়োৎসবেও কেনো পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয়নি? কেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে আগেভাগেই সতর্ক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে সাধারণ মানুষ।

এই মর্মান্তিক ঘটনা গোটা দেশের ক্রীড়া ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর নতুন করে আলো ফেলেছে। প্রশাসনের কাছে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ — এই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা, যেন ভবিষ্যতে আনন্দ কোনোভাবেই বিষাদে পরিণত না হয়।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button