বিশ্ব

সিরিয়া থেকে ‘প্রথমবারের মতো’ ইসরায়েলে রকেট হামলা

মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী দাবি করেছে, সিরিয়া থেকে গোলান মালভূমির দিকে রকেট নিক্ষেপ করা হয়েছে। ২০১১ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরুর পর বাশার আল-আসাদ সরকার পতনের পর এই প্রথমবারের মতো ইসরায়েলের ভূখণ্ডে এমন সরাসরি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে করে সিরিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যকার বিরাজমান উত্তেজনা নতুন মাত্রা পেয়েছে।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী (IDF) নিশ্চিত করেছে যে, মঙ্গলবার (৩ জুন) দক্ষিণ সিরিয়ার দারা অঞ্চল থেকে দুটি রকেট গোলান মালভূমির অভ্যন্তরে এসে পড়ে। তবে এতে কোনো হতাহত বা বড় ধরনের ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।

‘মোহাম্মদ দেইফ ব্রিগেডস’ গোষ্ঠীর দায় স্বীকার

রকেট হামলার দায় নিয়েছে একটি নতুন উদীয়মান সশস্ত্র গোষ্ঠী, যার নাম ‘মোহাম্মদ দেইফ ব্রিগেডস’। গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত হামাসের সামরিক প্রধান মোহাম্মদ দেইফ-এর নামে গোষ্ঠীটির নামকরণ করা হয়েছে। গোষ্ঠীটি টেলিগ্রামে দাবি করে, “দখলদার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সিরিয়ার ভূমি থেকেই আমরা জবাব দিয়েছি।”

তবে গোষ্ঠীটির বাস্তব অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকেরা। সিরিয়ার গবেষক আহমেদ আবা জেইদ বলেন, “এটি এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র একটি টেলিগ্রাম চ্যানেল হিসেবে সক্রিয়। এই গোষ্ঠীটি আসলেই অস্তিত্বশীল কি না, তা স্পষ্ট নয়।” ফলে এটি একটি সংঘবদ্ধ হামলা নাকি বিচ্ছিন্নভাবে পরিচালিত, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া: সিরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্টকে দায়ী করলেন কাৎজ

রকেট হামলার পর ইসরায়েল কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ এক বিবৃতিতে বলেন, “আমরা এই হামলার জন্য সিরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারাকে সরাসরি দায়ী করি।” তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে জানান, “এই হামলার পূর্ণাঙ্গ জবাব দ্রুতই আসবে।”

উল্লেখ্য, ২০২৪ সালে বাশার আল-আসাদের পতনের পর সিরিয়ার ক্ষমতায় আসে একটি ইসলামপন্থী বিদ্রোহী জোট, যার নেতৃত্বে রয়েছেন আহমেদ আল-শারা। ইসরায়েল এই সরকারকে এখনো পুরোপুরি স্বীকৃতি দেয়নি এবং দেশটির উদ্দেশ্য ও নীতির প্রতি গভীর সন্দেহ প্রকাশ করে আসছে।

ইসরায়েলের পাল্টা হামলা: দারা ও কুনাইত্রায় বিস্ফোরণ

রকেট হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল পাল্টা হামলা চালিয়েছে বলে জানিয়েছে সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা সানা (SANA)। তারা জানায়, ইসরায়েলি বাহিনী দারা প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে গোলাবর্ষণ করেছে। এতে উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

ব্রিটেনভিত্তিক যুদ্ধ-পর্যবেক্ষণ সংস্থা Syrian Observatory for Human Rights (SOHR) জানায়, ইসরায়েলি বিমান হামলায় কুনাইত্রা শহর ও দারা প্রদেশের গ্রামীণ অঞ্চলে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়েছে।

সিরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, “সিরিয়া থেকে ইসরায়েলের দিকে হামলার কোনো নিশ্চিত তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। আমাদের ভূখণ্ড কারো জন্য হুমকি ছিল না এবং হবেও না।” সেই সঙ্গে ইসরায়েলি গোলাবর্ষণের নিন্দা জানিয়ে বলা হয়, “এই হামলায় মানবিক ও বস্তুগত ক্ষতি হয়েছে যা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।”

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা

ঘটনার প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক পরিমণ্ডলেও আলোচনার ঝড় উঠেছে। বিশেষত এমন সময় এই হামলা ঘটল, যখন যুক্তরাষ্ট্র ও সিরিয়ার নতুন সরকারের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টার তথ্য সামনে এসেছে।

সম্প্রতি একাধিক মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সিরিয়ার ওপর থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল ও আল-শারা সরকারের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়াও এগোচ্ছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ পেয়েছে।

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা সম্প্রতি Jewish Journal-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমি ১৯৭৪ সালের যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে ফিরে যেতে আগ্রহী। তবে তাৎক্ষণিক স্বাভাবিকীকরণের কোনো প্রস্তাব দিচ্ছি না। শান্তি পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে হতে হবে, ভয়ের ভিত্তিতে নয়।”

এই অবস্থায় রকেট হামলা ও ইসরায়েলের কড়া প্রতিক্রিয়া পুরো অঞ্চলেই অস্থিরতা বাড়িয়ে তুলেছে।

সিরিয়া-ইসরায়েল সম্পর্কের নতুন মোড়

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এই রকেট হামলা ও পাল্টা প্রতিক্রিয়ার ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে উত্তেজনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। সিরিয়ায় রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর দেশটি অভ্যন্তরীণভাবে অস্থিতিশীল, এবং ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর উপস্থিতি নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।

ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরেই সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে হিজবুল্লাহ ও ইরানি প্রভাব মোকাবিলায় বিমান হামলা চালিয়ে আসছে। এখন নতুন সরকারের অধীনে এই হামলা সরাসরি সিরিয়া থেকে হলে, তা ইসরায়েলের নিরাপত্তা কৌশলে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিতে পারে।

বিশ্লেষকেরা আশঙ্কা করছেন, এই ঘটনার পেছনে যদি কোনো সংগঠিত জোটের হাত থাকে, তবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া আরও তীব্র হতে পারে। ফলে গোলান মালভূমি ও সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চল হয়ে উঠতে পারে নতুন সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button