গাজায় বেসামরিক মানুষের ওপর হামলা যুদ্ধাপরাধ: জাতিসংঘের মানবাধিকারপ্রধান

গাজায় চলমান সহিংসতা ও মানবিক সংকটকে কেন্দ্র করে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক এক কঠোর বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, বেসামরিক নাগরিকদের ওপর বারবার হামলা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘনের শামিল এবং এটি যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
তিনি গাজার খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রগুলোর কাছাকাছি এলাকায় ঘটমান হত্যাকাণ্ডগুলোর ওপর স্বাধীন তদন্ত দাবি করেন। একই সঙ্গে ইসরায়েলি নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ফিলিস্তিনিদের সামনে এখন কেবল দুটি ভয়াবহ বিকল্প রাখা হয়েছে—হয় অনাহারে মারা যাওয়া, না হয় সামান্য সহায়তা নিতে গিয়ে গুলিতে প্রাণ হারানো।
গাজায় চলমান মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র
ফলকার টুর্ক তাঁর বিবৃতিতে বলেন, গাজা উপত্যকায় মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে প্রতিনিয়ত বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে এটি ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্ভোগ সৃষ্টি করার সামিল এবং তা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
টুর্ক বলেন, “স্বল্প পরিমাণ খাদ্য সংগ্রহ করতে আসা নিরস্ত্র বেসামরিক মানুষের ওপর বারবার আক্রমণ করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক তিন দিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সমর্থিত খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রগুলোর আশপাশে বহু লোক নিহত হয়েছেন। এসব ঘটনার দায়ীদের অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।”
জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধানের মতে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর অবরোধ, হামলা ও মানবিক সহায়তার বাধা সৃষ্টি আন্তর্জাতিক মানবিক আইনকে চরমভাবে লঙ্ঘন করছে।
ইচ্ছাকৃত বাধা ও খাদ্যহীনতা: যুদ্ধাপরাধের আলামত
ফলকার টুর্ক বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, গাজাবাসীর জীবনকে এমন এক দুর্বিষহ অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যেখানে তারা প্রতিনিয়ত অনাহারে ভুগছেন। তিনি বলেন, “ক্ষুধার হুমকি, ২০ মাসব্যাপী নির্বিচার বোমাবর্ষণ ও হামলা, বারবার বাস্তুচ্যুতি এবং গাজাকে জনশূন্য করার পরিকল্পনা—এসব কৌশল আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন।”
গাজা পরিস্থিতিকে টুর্ক বিশ্বব্যাপী বিবেকের জন্য একটি লজ্জাজনক অধ্যায় বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “একটি জনপদের ওপর এত দীর্ঘ সময় ধরে অবিরাম সামরিক অভিযান, মানবিক সহায়তার প্রতিবন্ধকতা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যকর উদ্যোগের অভাব গভীর উদ্বেগজনক।”
জাতিসংঘের আহ্বান: স্বাধীন তদন্ত ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক দপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলার প্রতিটি ঘটনা স্বাধীনভাবে তদন্ত করতে হবে।
টুর্ক বলেন, “নিহতদের পরিবার ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রাখে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে ঘটনার পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরা এবং দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা।”
তিনি আরও বলেন, “দায়মুক্তির সংস্কৃতি বন্ধ না হলে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত হতে পারে।”
গাজা পরিস্থিতি: মানবিক বিপর্যয় ও আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা
বর্তমানে গাজা উপত্যকায় খাদ্য, পানি, ওষুধ ও জ্বালানির ভয়াবহ সংকট চলছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ইতোমধ্যেই হুঁশিয়ারি দিয়েছে, যদি সহায়তা অব্যাহতভাবে ব্যাহত হয়, তাহলে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই লাখ লাখ মানুষ চরম মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে পারে।
জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা বারবার আহ্বান জানালেও অবরোধ ও হামলা বন্ধ হয়নি। টুর্ক বলেন, “এই ধ্বংসযজ্ঞ ও নিষ্ঠুরতা অবিলম্বে বন্ধ না হলে ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায় রচিত হবে, যার দায় আমাদের সবাইকেই নিতে হবে।”
ফলকার টুর্কের বার্তা: মানবিক মূল্যবোধের প্রতি বিশ্ব বিবেকের দায়িত্ব
জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান তাঁর বিবৃতির শেষে বলেন, “মানবিক মূল্যবোধ, আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবাধিকারের প্রতি আমাদের সম্মিলিত দায়বদ্ধতা আজ প্রশ্নের মুখে। গাজার জনগণ আজ কেবল বেঁচে থাকার অধিকার চায়। আমাদের দায়িত্ব তাদের সেই অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া।”
তিনি বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান, গাজায় অবিলম্বে অস্ত্রবিরতি ঘোষণা করা হোক এবং অবারিত মানবিক সহায়তা প্রবেশের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হোক।
উপসংহার
গাজায় চলমান এই মানবিক বিপর্যয়ের পেছনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তা বড় প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে। জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠান যখন স্পষ্টভাবে যুদ্ধাপরাধের কথা বলে, তখন বিশ্ব নেতাদের এড়িয়ে যাওয়ার আর সুযোগ নেই। সময় এসেছে—নিরীহ মানুষের জীবন রক্ষায়, ন্যায়ের স্বার্থে, ও আন্তর্জাতিক আইন প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় হয়ে ওঠার।