বিশ্ব

ভারতে মুসলিম শিশুকে উল্টো করে ঝুলিয়ে ‘ইলেকট্রিক শক’

ভারতের কলকাতার অদূরে মহেশতলা পৌরসভা এলাকায় একটি জিন্সের পোশাক রঙ করার কারখানায় চাঞ্চল্যকর ও মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। এক ১৪ বছর বয়সী মুসলিম শিশু, সামসাদ আলীকে মোবাইল চুরির মিথ্যা অভিযোগে উল্টো করে ঝুলিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। শিশুটিকে দুই হাত বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে বিদ্যুতের তার দিয়ে বারবার ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর স্থানীয় জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। পুলিশ এই ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে এবং অভিযুক্তদের গ্রেফতারের জন্য তল্লাশি চালাচ্ছে।

ঘটনার বিবরণ

ঘটনাটি ঘটেছে মহেশতলা পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কানখুলি পূর্বপাড়া এলাকায়। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শিলিগুড়ির বাসিন্দা শাহেনশাহ নামে এক ব্যক্তি এই এলাকায় একটি বাড়ি ভাড়া করে জিন্সের পোশাক রঙ করার কারখানা পরিচালনা করেন। এই কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করতো ১৪ বছর বয়সী সামসাদ আলী, যিনি ইসলামপুরের বাসিন্দা। সামসাদ এবং তার বড় ভাই আনসার আলী দেড় মাস আগে এক পরিচিতের মাধ্যমে কলকাতায় কাজের জন্য এসেছিলেন।

স্থানীয় সূত্র এবং পুলিশের বরাতে জানা গেছে, কারখানার কয়েকজন প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিক সামসাদের বিরুদ্ধে মোবাইল চুরির অভিযোগ তুলে তাকে উল্টো করে ঝুলিয়ে মারধর করে। শুধু মারধর নয়, তারা শিশুটির শরীরে বিদ্যুতের তার সংযোগ করে বারবার ইলেকট্রিক শক দেয়। ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর সামসাদের পরিবার ইসলামপুর থানা ও মহেশতলার রবীন্দ্রনগর থানায় অভিযোগ দায়ের করে।

ভিডিও ভাইরাল ও জনরোষ

ভিডিওটিতে দেখা যায়, সামসাদকে জিন্সের হাফ প্যান্ট ও পুরনো টিশার্ট পরা অবস্থায় দুই হাত বাঁধা অবস্থায় উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তার হাতে বিদ্যুতের তার সংযুক্ত, এবং একজন যুবক কিছুক্ষণ পরপর তারটি বিদ্যুতের প্লাগে গুঁজে শিশুটির শরীরে শক দিচ্ছেন। এই দৃশ্য দেখে সামসাদের শরীর কাঁপতে থাকে, যা দর্শকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও শিহরন সৃষ্টি করেছে।

সামসাদের পরিবার জানায়, তারা ইসলামপুরের ছঘরিয়া গ্রামে বসে এই ভিডিও দেখে চমকে যান। তারা অভিযোগ করেন, সামসাদ কোনো মোবাইল চুরি করেনি। তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলে তাকে এই নির্মম নির্যাতনের শিকার করা হয়েছে। সামসাদের এক চাচা বলেন, “খোঁজ নিয়ে আমরা জানতে পারি, সে মোবাইল চুরি করেনি। মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তাকে এভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। আমরা পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছি।”

স্থানীয় জনগণ এই ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা অভিযুক্তদের দ্রুত গ্রেফতার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। সামাজিক মাধ্যমে এই ঘটনা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে, এবং অনেকে এটিকে মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

পুলিশের পদক্ষেপ

মহেশতলা পুলিশ জানিয়েছে, তারা ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে। অভিযুক্তরা ঘটনার পর থেকে পলাতক রয়েছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, শাহেনশাহ নামে কারখানার মালিকের পরিবারের একজন সদস্য দাবি করেছেন, ভিডিওটি “মজা করার জন্য” বানানো হয়েছিল। তবে পুলিশ এই দাবি যাচাই করছে এবং অভিযুক্তদের খুঁজে বের করার জন্য তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছে।

ইসলামপুর থানার পাটাগোড়া ফাঁড়ির পুলিশ সামসাদের পরিবারের অভিযোগ গ্রহণ করেছে। পরিবারের দাবি, পুলিশ যেন শিশুটিকে নিরাপদে বাড়িতে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়। এদিকে, প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শিশু সুরক্ষা আইন অনুযায়ী এই ঘটনায় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

শিশু নির্যাতনের প্রেক্ষাপট

ভারতে শিশু নির্যাতনের ঘটনা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে ভারতে প্রায় ২০,০০০ শিশু ও কিশোরী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। এছাড়াও, শিশুদের উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনাও গত এক দশকে উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ঘটনাগুলোর মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই অভিযুক্তরা শাস্তি এড়িয়ে যায়, যা সমাজে ন্যায়বিচারের প্রতি প্রশ্ন তুলেছে।

মহেশতলার এই ঘটনাটি শিশু নির্যাতনের আরেকটি ভয়াবহ উদাহরণ। বিশেষ করে, সামসাদের মুসলিম পরিচয় এই ঘটনাকে ধর্মীয় সংবেদনশীলতার দিকে নিয়ে গেছে। ভারতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও বৈষম্যমূলক আচরণের অভিযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্প্রতি ভারতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে “ইচ্ছাকৃত উসকানি” এবং “রাষ্ট্রীয় মদদে নিপীড়ন” চলছে বলে অভিযোগ করেছে।

সমাজের প্রতিক্রিয়া ও দাবি

মহেশতলার সাধারণ মানুষ এই ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযুক্তদের দ্রুত গ্রেফতার এবং শিশু সুরক্ষা আইনের আওতায় কঠোর শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। সামাজিক মাধ্যমে এই ঘটনা নিয়ে তীব্র সমালোচনা চলছে। অনেকে এই ঘটনাকে শিশু শ্রম এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছেন।

সামসাদের পরিবার জানিয়েছে, তারা শিশুটির নিরাপত্তা এবং সুস্থতার জন্য উদ্বিগ্ন। তারা পুলিশের কাছে দাবি জানিয়েছেন, সামসাদকে যেন দ্রুত উদ্ধার করে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়। এছাড়াও, তারা এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং ন্যায়বিচারের দাবি করেছেন।

শিশু শ্রম ও নির্যাতন: একটি সামাজিক সমস্যা

এই ঘটনা ভারতে শিশু শ্রম এবং শিশু নির্যাতনের একটি বৃহত্তর সমস্যার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ভারতে শিশু শ্রম নিষিদ্ধ হলেও, অনেক শিশু এখনও কঠিন পরিস্থিতিতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব এবং সামাজিক অসচেতনতার কারণে শিশুরা প্রায়ই শোষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়। সামসাদের মতো শিশুরা, যারা দরিদ্র পরিবার থেকে এসে কাজের জন্য শহরে আসে, তারা বিশেষভাবে ঝুঁকির মধ্যে থাকে।

এই ঘটনা শিশু সুরক্ষা আইনের কার্যকর বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে, স্থানীয় জনগণের অভিযোগ, এ ধরনের ঘটনাগুলো প্রায়ই ধামাচাপা দেওয়া হয়, এবং অভিযুক্তরা শাস্তি এড়িয়ে যায়।

উপসংহার

মহেশতলার এই ঘটনা শুধু একটি শিশুর উপর নির্যাতনের ঘটনা নয়, এটি সমাজের একটি গভীর সমস্যার প্রতিফলন। শিশু শ্রম, ধর্মীয় বৈষম্য, এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো বিষয়গুলো এই ঘটনার মাধ্যমে সামনে এসেছে। সামসাদ আলীর উপর এই নির্মম নির্যাতনের ঘটনা সমাজের সকল স্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং কঠোর আইনি পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে। পুলিশ তদন্তের মাধ্যমে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করতে পারলে এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারলে, এটি ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা রোধে একটি দৃষ্টান্ত হতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button