বিশ্ব

গাজায় ত্রাণকেন্দ্রে আবার ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি হামলায় ২৭ জন নিহত

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় আবারও ত্রাণের জন্য অপেক্ষমাণ নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্বিচার গুলিবর্ষণ চালিয়েছে ইসরায়েলি সেনারা। আজ মঙ্গলবার (৩ জুন) দক্ষিণ গাজার রাফা অঞ্চলের একটি ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রের কাছে এই হামলায় অন্তত ২৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং আরও বহু মানুষ আহত হয়েছেন। হামলার সময় বহু নারী ও শিশুও সেখানে উপস্থিত ছিল। এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক মহলে নিন্দার ঝড় উঠেছে, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন।

আবারও ত্রাণকেন্দ্রে ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, আজকের হামলাটি চালানো হয় রাফার একটি ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রের সন্নিকটে, যেখানে শত শত ক্ষুধার্ত মানুষ খাবারের আশায় জড়ো হয়েছিলেন। হঠাৎই ইসরায়েলি সেনারা নির্বিচার গুলি চালাতে শুরু করলে হতাহতের ঘটনা ঘটে।

ছড়িয়ে পড়া ভয়াবহ ভিডিও ও আল–নসর হাসপাতালের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়া শিশুদের দৃশ্য এই মানবিক বিপর্যয়ের মর্মস্পর্শী চিত্র তুলে ধরছে।

ইসরায়েলের বক্তব্য: “নির্ধারিত পথ থেকে সরে গিয়েছিল কিছু লোক”

তবে ইসরায়েলি বাহিনী দাবি করেছে, রাফার যে ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রের কাছে এই গুলির ঘটনা ঘটেছে, সেখানে কিছু লোক ‘নির্ধারিত চলাচলের পথ’ ছেড়ে সরে গিয়েছিল এবং তাদের ওপর সন্দেহভাজন হিসেবে প্রথমে সতর্কতামূলক গুলি ছোড়া হয়। কিন্তু তারা থামেনি বলেই পরে আরও গুলি করা হয়।

ইসরায়েল আরও বলেছে, তারা ত্রাণ নিতে আসা নিরীহ মানুষদের টার্গেট করেনি, বরং “সন্দেহভাজনদের” লক্ষ্য করেই গুলি চালানো হয়েছিল। যদিও এ বিষয়ে নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক তদন্ত এখনো হয়নি।

এক সপ্তাহে ৬০-এর বেশি নিহত

গত এক সপ্তাহের মধ্যেই গাজায় ত্রাণ সংগ্রহের সময় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা ৬০ ছাড়িয়েছে। গত রোববার একইভাবে একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের কাছে গুলি চালানো হলে অন্তত ৩১ জন ফিলিস্তিনি প্রাণ হারান। পরদিন সোমবার আরও তিনজন নিহত হন।

এই ধারাবাহিক সহিংসতা গাজার মানবিক পরিস্থিতিকে আরও গভীর সংকটে ফেলে দিয়েছে।

ইসরায়েলি সেনারাও নিহত: উত্তেজনা বাড়ছে

আজকের এই হামলার কয়েক ঘণ্টা আগেই ইসরায়েল জানিয়েছিল, গাজার উত্তরে হামাসের সঙ্গে সংঘর্ষে তাদের তিনজন সেনা নিহত হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই হামলার জবাবে দক্ষিণ গাজার ত্রাণকেন্দ্রের কাছে নির্বিচারে গুলি চালানো হয়।

মানবিক সহায়তায় জিএইচএফ বিতর্ক

যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (GHF) গত সপ্তাহে গাজায় তাদের প্রথম ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র চালু করেছে। তারা জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার বদলে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ত্রাণ কার্যক্রম চালাচ্ছে।

তবে জাতিসংঘসহ প্রথাগত মানবিক সংস্থাগুলো এই উদ্যোগের কড়া সমালোচনা করেছে। তাদের মতে, জিএইচএফের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণ মানবিক সহায়তার আন্তর্জাতিক নীতিমালার পরিপন্থী এবং এতে ত্রাণকর্মীদের নিরাপত্তা, নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

আজকের হামলার আগেও GHF দাবি করেছিল, তারা মঙ্গলবার সকালেই ২১টি ট্রাকে করে নিরাপদে খাবার বিতরণ করেছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র তার উল্টো—ত্রাণ সংগ্রহের সময়ই হামলা এবং মৃত্যু।

জাতিসংঘের উদ্বেগ ও তদন্তের দাবি

এই ঘটনায় জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গতকাল (সোমবার) গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “ত্রাণ নিতে গিয়ে ফিলিস্তিনিদের মৃত্যু ও আহত হওয়ার ঘটনা অত্যন্ত মর্মান্তিক। এটি অবশ্যই স্বাধীনভাবে তদন্ত করা উচিত।”

মানবাধিকার সংস্থাগুলোও একই দাবি তুলেছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ফিলিস্তিনে সংঘটিত এই হত্যাকাণ্ডগুলোর প্রতি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানিয়েছে।

৫৪ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত: অব্যাহত ধ্বংসযজ্ঞ

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি হামলায় এ পর্যন্ত গাজায় ৫৪ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এই হামলায় ধ্বংস হয়েছে গাজার হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ ও বসতবাড়ি—একটি সভ্য জাতিকে শিকড়ে আঘাত করার জন্য যেন কিছুই বাদ রাখা হয়নি।

জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, ইসরায়েল গাজায় সংঘটিত এসব হামলায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও যুদ্ধ আইনের মারাত্মক লঙ্ঘন করেছে।

ভবিষ্যৎ কী?

গাজায় বর্তমান মানবিক পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। খাদ্য, পানি, ওষুধের চরম সংকট; আশ্রয়হীন লক্ষাধিক মানুষ এবং প্রতিদিন নতুন করে মৃত্যু ও ধ্বংস—এসব মিলিয়ে এটি একটি ‘মানবিক দুর্যোগ অঞ্চল’-এ পরিণত হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি আন্তর্জাতিক মহল এখনই জোরালো পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে গাজা খুব শিগগিরই এক ‘বাসযোগ্য শূন্যভূমি’তে পরিণত হতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button