মার্কিন-ইসরায়েলি হামলার শঙ্কায় ইরান, প্রতিরক্ষায় প্রস্তুতির শেষ নেই

ইরান ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে যখন পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনার টানাপোড়েন চলছে, তখন তেহরানের ওপর ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্র—or দু’জনের সম্মিলিত হামলা—ঘটে যেতে পারে এমন আশঙ্কা বাড়ছে। ফলে, দেশটি এখন নিজের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজাচ্ছে, আগের চেয়ে আরও বেশি সক্রিয় ও প্রযুক্তিনির্ভর কৌশলে।
প্রতিরক্ষায় নতুন বিন্যাস
২০২৪ সালের অক্টোবর ও এপ্রিল মাসে ইসরায়েলের বিমান হামলায় ইরানের একাধিক আকাশ প্রতিরক্ষা ইনস্টলেশন ও রাডার ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বিশেষ করে রাশিয়ার তৈরি এস-৩০০ সিস্টেম। ওই ঘটনার পর ধারণা জন্মেছিল, ইরান কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে অরক্ষিত অবস্থায় আছে।
কিন্তু সাম্প্রতিক স্যাটেলাইট চিত্র ও গোয়েন্দা বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ইরান দ্রুততার সঙ্গে তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলো মেরামত ও নতুনভাবে বিন্যস্ত করছে। দেশটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনার (যেমন নাতানজ ও ফোরদো) আশেপাশে এস-৩০০ লঞ্চার ও রাডার পুনঃস্থাপন করেছে।
দেশীয় প্রযুক্তির বিকাশ
রাশিয়ার কাছ থেকে অত্যাধুনিক এস-৪০০ সিস্টেম না পাওয়ার কারণে ইরান নিজস্ব প্রযুক্তির উপর নির্ভরতা বাড়িয়েছে। স্থানীয়ভাবে নির্মিত বাভার-৩৭৩ (দূরপাল্লার) এবং খোরদাদ-১৫ (মাঝারি পাল্লার) ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইরানের প্রতিরক্ষায় বড় ভরসা হয়ে উঠছে।
সাম্প্রতিক সময়ে এস-৩০০ সিস্টেমের মূল রাডার বিকল হওয়ায় ইরান নিজস্ব রাডার প্রযুক্তি দিয়ে তা পরিচালনা করে দেখিয়েছে, যা প্রতিরক্ষা খাতে তাদের আত্মনির্ভরশীলতার প্রমাণ।
বড় বিনিয়োগ, উচ্চ সতর্কতা
ইরানের সামরিক প্রধান মোহাম্মদ বাঘেরি সম্প্রতি বলেছেন, আকাশ প্রতিরক্ষা খাতে ‘কয়েকগুণ বিনিয়োগ’ এবং ‘উল্লেখযোগ্য উন্নতি’ হয়েছে। তিনি হুঁশিয়ার করে বলেন, আকাশসীমা লঙ্ঘনের ঘটনা আক্রমণকারী পক্ষের জন্য ‘গুরুতর ক্ষতি’ বয়ে আনবে।
সম্ভাব্য যুদ্ধ পরিকল্পনা
ওয়াশিংটনের সঙ্গে ইরানের আলোচনা স্থগিত হয়ে গেলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারো আক্রমণের হুমকি দিয়েছেন। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ছয়টি বি-২ স্টিলথ বোমারু বিমান ভারত মহাসাগরের দিয়েগো গার্সিয়া ঘাঁটিতে মোতায়েন করেছে। এই বিমানগুলো ৩০ হাজার পাউন্ডের ‘জিবিইউ-৫৭ বাংকার ব্লাস্টার’ বোমা বহনে সক্ষম—যা ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনাকে টার্গেট করতে পারে।
অন্যদিকে ইসরায়েলের বিকল্প তুলনামূলক সীমিত। তাদের কাছে বড় আকারের বোমারু বিমান না থাকায় তারা এফ-৩৫ স্টেলথ ফাইটার বা এফ-১৫ ব্যবহার করে ২ হাজার থেকে ৪ হাজার পাউন্ড ওজনের নির্ভুল বোমা দিয়ে আঘাত হানতে পারে। তবে একই অবস্থানে একাধিকবার আক্রমণের প্রয়োজন পড়বে, যার ফলে তাদের ট্যাংকার বিমানে মাঝ আকাশে জ্বালানি নিতে হবে—এই ট্যাংকারগুলো আবার ইরানের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের জন্য অরক্ষিত।
প্রতিরক্ষা কৌশলে মোবাইল প্রযুক্তি
ইরানের প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও মোবাইল বা চলনক্ষম করেছে। অর্থাৎ, এসব ব্যবস্থা সহজেই স্থান পরিবর্তন করে কঠিন আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যেতে পারে, ফলে এসব আঘাত এড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
বিশেষজ্ঞ ইউরি লিয়ামিন বলেন, এই নতুন মোবাইল প্রতিরক্ষা পদ্ধতি ও বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে রাখা রাডার ও লঞ্চারগুলো ইরানকে তুলনামূলক সুরক্ষিত করেছে।
আকাশযুদ্ধের সম্ভাব্য চিত্র
ইসরায়েল ও ইরান উভয়ই সম্ভাব্য আকাশযুদ্ধের জন্য দীর্ঘদিন ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি সফল হামলা নির্ভর করবে কে কত ভালোভাবে আক্রমণ ও প্রতিরক্ষা সমন্বয় করতে পারে তার উপর। লিয়ামিন বলেন, “সেরা দলই জয়ী হবে।”
তবে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে ইসরায়েলি পাইলটদের ক্লান্তি ও ঝুঁকি বাড়বে, কারণ তাদের একাধিকবার উড্ডয়ন ও জ্বালানি পুনঃভরার মতো জটিলতায় পড়তে হবে।
২০১৮ সালে সিরিয়ার এস-২০০ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইসরায়েলের একটি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান গুলি করে নামানোর উদাহরণ দিয়ে লিয়ামিন বলেন, এমনকি পুরনো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও কার্যকর হতে পারে যদি কৌশলগতভাবে সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয়।
ইরান এখন আর শুধু প্রতিক্রিয়াশীল নয়, বরং একটি সম্ভাব্য আক্রমণের আগাম প্রস্তুতিতে সচেষ্ট। দেশটির প্রতিরক্ষা কাঠামো এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি গতিশীল, মোবাইল ও প্রযুক্তিনির্ভর।
মার্কিন ও ইসরায়েলি নেতৃত্বের যে-কোনো হঠাৎ সিদ্ধান্ত শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, গোটা বিশ্বের জন্য বড় ধরনের সামরিক সংঘর্ষের দিকে নিয়ে যেতে পারে। ভুল কৌশল বা অপারেশনাল ভুল—উভয়পক্ষের জন্যই ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।