আবহাওয়া

বায়ুদূষণে বিশ্বে প্রথম অবস্থানে ঢাকা

Advertisement

বিশ্বব্যাপী বায়ুদূষণ দিন দিন বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন, দ্রুত নগরায়ন, শিল্পায়ন, যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং অসচেতন নাগরিক কার্যক্রম মিলিতভাবে শহরগুলোর বাতাসকে দূষিত করে তুলছে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা আবারও বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের শীর্ষে উঠে এসেছে।

সোমবার সকাল ৯টা ১ মিনিটে প্রকাশিত বায়ুমানের সূচক অনুযায়ী ঢাকার স্কোর ছিল ২৭১, যা ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। এই মাত্রার বায়ু সকল মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

একই সময়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিল মিশরের রাজধানী কায়রো, যার স্কোর ২৬০। তৃতীয় স্থানে রয়েছে ভারতের রাজধানী দিল্লি, যার স্কোর ২৫১। এ তিনটি শহরই তীব্র দূষণের চাপে রয়েছে, তবে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে ঢাকায়।

ঢাকায় বায়ুদূষণ বৃদ্ধির কারণ

ঢাকার বায়ুদূষণের পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ। পরিবেশ অধিদপ্তর, গবেষক এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী প্রধান কারণগুলো হলো:

১. নির্মাণকাজের ধুলা

ঢাকায় প্রতিদিন বড় ও ছোট নির্মাণকাজ চলছে। রাস্তা খোঁড়া, ড্রেনেজ উন্নয়ন, ভবন নির্মাণ, ফ্লাইওভার নির্মাণ—all these processes contribute to dust particles in the air. এই ধুলা বাতাসে ভাসমান ক্ষুদ্র কণায় (PM2.5 ও PM10) পরিণত হয়, যা মানুষের ফুসফুসে প্রবেশ করে।

২. যানবাহনের ধোঁয়া

ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ৩৫ লাখ যানবাহন চলাচল করে। পুরনো গাড়ি, নিম্নমানের জ্বালানি এবং জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ি বাতাসে কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড এবং ক্ষুদ্র কণা নিঃসরণ করে।

৩. ইটভাটা

শীতের সময় ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় হাজার হাজার ইটভাটা সক্রিয় হয়। এই ইটভাটা থেকে ব্ল্যাক স্মোক, কার্বন ডাইঅক্সাইড, সালফার এবং ক্ষুদ্র কণা PM2.5 নির্গত হয়। গবেষকরা মনে করেন, ঢাকার বায়ুদূষণের প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ দায়ী ইটভাটাকে।

৪. শিল্পকারখানার বর্জ্য

গার্মেন্টস, প্লাস্টিক ফ্যাক্টরি, ট্যানারি, কেমিক্যাল ও ইস্পাত শিল্প থেকে বাতাসে ক্ষতিকর গ্যাস নির্গত হয়। অনেক প্রতিষ্ঠান পরিবেশবান্ধব নির্গমন নিয়ন্ত্রণ সরঞ্জাম ব্যবহার করে না।

৫. আবর্জনা পোড়ানো

রাস্তার ধারে বা খোলা জায়গায় আবর্জনা পোড়ানো হয়। বিশেষ করে প্লাস্টিক পোড়ালে ডাইঅক্সিন নিঃসরণ হয়, যা ক্যানসার, হরমোনজনিত সমস্যা এবং শিশুদের মানসিক বিকাশে ক্ষতি করতে পারে।

৬. জলবায়ু পরিবর্তন ও মৌসুমি ধোঁয়াশা

শীতের সময় তাপমাত্রা কমে এবং বাতাসের গতি হ্রাস পায়। ধুলা ও কণার ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়, কুয়াশা ও ধোঁয়া মিশে ‘স্মগ’ তৈরি হয়, যা দূষণ আরও বাড়ায়।

AQI স্কোর ও এর ব্যাখ্যা

বায়ুর মান বোঝাতে AQI বা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স ব্যবহৃত হয়। স্কোর সাধারণত ০ থেকে ৫০০ পর্যন্ত নির্ধারিত হয় এবং মানুষের স্বাস্থ্যের ঝুঁকির সঙ্গে সম্পর্কিত।

স্কোরবায়ুর মানব্যাখ্যা
0–50ভালোকোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই
51–100মাঝারিসংবেদনশীলদের জন্য ক্ষুদ্র ঝুঁকি
101–150সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকরহাঁপানি রোগীদের ঝুঁকি বাড়ে
151–200অস্বাস্থ্যকরসব মানুষের জন্য ঝুঁকি
201–300খুবই অস্বাস্থ্যকরগুরুতর ক্ষতি হতে পারে
301+বিপর্যয়করসর্বোচ্চ ঝুঁকি

ঢাকার ২৭১ স্কোর তাই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

বায়ুদূষণের স্বাস্থ্যঝুঁকি

ক্ষুদ্র PM2.5 কণা ফুসফুসে গিয়ে রক্তে প্রবেশ করে। দীর্ঘমেয়াদী এক্সপোজারের ফলে হতে পারে:

  • শ্বাসকষ্ট ও স্থায়ী কাশি
  • ব্রংকাইটিস
  • ফুসফুস ক্যানসার
  • হৃদরোগ ও স্ট্রোক
  • কিডনি রোগ
  • চোখ, নাক ও গলার সংক্রমণ

বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১.৮–২ লাখ মানুষের মৃত্যু বায়ুদূষণজনিত কারণে ঘটে।

ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী

  • শিশু
  • বয়স্ক ব্যক্তি
  • গর্ভবতী নারী
  • হাঁপানি বা শ্বাসকষ্ট রোগী
  • বাইরে কাজ করা শ্রমিক
  • ট্রাফিক পুলিশ ও ড্রাইভার

চিকিৎসকদের পরামর্শ

  • অপ্রয়োজনীয়ভাবে বাইরে বেরোবেন না
  • N95 বা Surgical Mask ব্যবহার করুন
  • চোখে অ্যালার্জি থাকলে চশমা ব্যবহার করুন
  • প্রচুর পানি পান করুন
  • বাসায় এয়ার পিউরিফায়ার ব্যবহার করুন

সরকার ও প্রশাসনের পদক্ষেপ

  • রাস্তা পরিষ্কার ও পানি ছিটানোর ব্যবস্থা
  • ইটভাটা আধুনিক প্রযুক্তিতে রূপান্তর
  • নির্মাণকাজে ডাস্ট ম্যানেজমেন্ট বাধ্যতামূলক
  • শিল্পকারখানায় নির্গমন নিয়ন্ত্রণ
  • শহরে সবুজায়ন উদ্যোগ

প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ

  • নির্মাণকাজে ধুলা নিয়ন্ত্রণ
  • গণপরিবহন উন্নয়ন ও যানবাহন সংখ্যা কমানো
  • পরিবেশবান্ধব ইটভাটা প্রযুক্তি ব্যবহার
  • বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও আবর্জনা পোড়ানো বন্ধ
  • রাস্তায় পানি ছিটানো
  • শহরে গাছ ও পার্ক বৃদ্ধি
  • জনসচেতনতা বৃদ্ধি

বিশ্বের অন্যান্য দূষিত শহর

আজকের দিনে দূষণের শীর্ষে রয়েছে:

  1. ঢাকা, বাংলাদেশ — ২৭১
  2. কায়রো, মিশর — ২৬০
  3. দিল্লি, ভারত — ২৫১
  4. লাহোর, পাকিস্তান
  5. করাচি, পাকিস্তান
  6. তাশখন্দ, উজবেকিস্তান

ঢাকা আজ বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর হিসেবে স্বীকৃত। এটি শুধু পরিবেশ সমস্যা নয়, বরং মানবজীবন ও স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়। দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ ও দীর্ঘমেয়াদী নীতি প্রয়োগ না করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।

MAH – 14178 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button