পঞ্চগড় জেলার সীমান্ত উপজেলা তেঁতুলিয়া বাংলাদেশের ‘শীতের রাজধানী’ হিসেবে বহুদিন ধরেই পরিচিত। প্রতি বছর শীত মৌসুমে প্রথম ঠান্ডার ছোঁয়া এখানেই অনুভূত হয় এবং সারাদেশে সর্বনিম্ন তাপমাত্রাও সাধারণত তেঁতুলিয়াতেই রেকর্ড করা হয়।
২০২৫ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই সেখানে শীতের প্রকোপ স্পষ্টভাবে বাড়তে শুরু করেছে। টানা কয়েক দিন ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠানামার পর গতকাল তেঁতুলিয়ায় তাপমাত্রা নেমে আসে মৌসুমের সর্বনিম্ন ১১.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। আর আজ বুধবার সকাল ৯টায় রেকর্ড করা হয় ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ ছিল ৮৭ শতাংশ। এই আর্দ্রতা এবং কুয়াশার ঘনত্ব মিলিয়ে ভোর থেকে সকাল পর্যন্ত পুরো এলাকায় যেন শীতের ‘প্রথম ঝাপটা’ আরও তীব্র হয়ে ওঠে।
ঘন কুয়াশায় সড়কে যানবাহনের গতি কমে আসে
তেঁতুলিয়া-পঞ্চগড় সড়ক, বাংলাবান্ধা-ভিতরগ্রাম এলাকা, ডাকবাংলো মোড় — সব জায়গায়ই ভোরে নেমে আসে ঘন কুয়াশার চাদর।
সকালে সড়কে চলাচলকারী যানবাহনগুলো বাধ্য হয়ে হেডলাইট জ্বালিয়ে অত্যন্ত ধীরগতিতে চলতে দেখা যায়।
স্থানীয় ট্রাক, অটোভ্যান, মোটরসাইকেল—সব ধরনের যানবাহনের গতিতে স্পষ্ট প্রভাব পড়ে।
মোটরসাইকেল চালক মাসুদ বলেন,
“হাতমোজা পরে বাইকে উঠলেও হাত কাজ করে না। কুয়াশার কারণে রাস্তার দিক দেখা যায় না, তাই হেডলাইট জ্বালিয়ে আস্তে যেতে হয়।”
এই পরিস্থিতি শুধু যানবাহন নয়, মানুষের স্বাভাবিক চলাচলকেও ধীর করে দিয়েছে। বাজারে মানুষের উপস্থিতি কম, ভোরের দিকে দোকানপাটও দেরিতে খুলছে।
মার্কিন জরিপে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে শীত বাড়ার সম্ভাবনা
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আবহাওয়া বিশ্লেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাম্প্রতিক কয়েকটি রিপোর্টে বলা হয়েছে—
২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জানুয়ারির প্রথম ভাগ পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কিছু অঞ্চলে স্বাভাবিকের চেয়ে নিম্ন তাপমাত্রার প্রবণতা দেখা যেতে পারে।
এতে বিশেষভাবে উল্লেখ রয়েছে—
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, বিশেষ করে পঞ্চগড়, নিলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর ও কুড়িগ্রাম এলাকায় তাপমাত্রা ডিসেম্বরেই উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যেতে পারে।
শীতের তীব্রতা বাড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে—
- হিমালয় অঞ্চল থেকে নেমে আসা শুষ্ক শীতল বায়ু
- উত্তরবঙ্গের উন্মুক্ত সমতল এলাকায় আর্দ্রতা স্থির হওয়া
- নদীখাত ও নিম্নাঞ্চলে কুয়াশা জমে থাকা
- লা নিনার সম্ভাব্য প্রভাব
এ গবেষণাগুলো বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।
আবহাওয়া অফিসের মতে শৈত্যপ্রবাহের ইঙ্গিত
তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জিতেন্দ্রনাথ রায় বলেন—
“তেঁতুলিয়ায় তাপমাত্রা প্রতিদিনই নিচের দিকে নামছে। কয়েক দিন ধরে ১৩ ডিগ্রির ঘরে ছিল, গতকাল নেমে আসে ১১.৭-এ। এভাবে ডিসেম্বরের শুরুতেই শীত বাড়লে সামনে শৈত্যপ্রবাহ দেখা দিতে পারে।”
তাঁর মতে, ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে অঞ্চলটিতে ‘মৃদু শৈত্যপ্রবাহের’ সম্ভাবনা তৈরি হয়।
উত্তরবঙ্গে এই শৈত্যপ্রবাহ প্রথমে শুরু হলেও পরে তা দেশের মধ্যাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
দিনের বেলা রোদ থাকলেও কমছে না শীতের অনুভূতি
গতকাল দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ২৬.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোদ পাওয়া গেলেও ভোর ও সকালের কনকনে ঠান্ডা মিলিয়ে ২৪ ঘণ্টা ধরে শীতের প্রভাব টিকে থাকছে।
বিশেষ করে ভোরের সময় তাপমাত্রা দ্রুত নিচে নেমে আসে। রাতেও বাতাসে শীতলতার আধিক্য থাকায় ঘরবাড়ি ও খোলা স্থানে দীর্ঘক্ষণ ঠান্ডা বাতাস জমে থাকছে।
শ্রমজীবী মানুষের দুশ্চিন্তা বাড়ছে
সর্বনিম্ন দৈনিক মজুরি নির্ভর শ্রমজীবী মানুষদের জন্য এই শীত যেন বড় কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দৈনিক মজুরির শ্রমিক হুসেন উদ্দিন বলেন—
“কাজ না করলে আয় নেই। কিন্তু এত ঠান্ডায় সকালেই কাজে যাওয়া কঠিন হয়ে যায়। তারপরও পেটের দায়ে বের হতেই হয়।”
শীতের কারণে কৃষিকাজ, ইটভাটা, চা-বাগান, পর্যটন শ্রমিক—সব ক্ষেত্রেই কাজের সময় কমে যাচ্ছে।
অনেকে ভোরের কাজ বাদ দিয়ে রোদ উঠার পর কাজ শুরু করছেন।
এতে কাজের সময় কমে যাওয়ায় দৈনিক আয়েও প্রভাব পড়ছে।
তেঁতুলিয়ায় শীতের ইতিহাস: প্রতিবছরই নতুন রেকর্ড
তেঁতুলিয়া দেশের সবচেয়ে ঠান্ডা অঞ্চল হিসেবে পরিচিত।
গত কয়েক বছরের শীতকালীন তাপমাত্রার দিকে তাকালে দেখা যায়—
- ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে সর্বকালের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল তেঁতুলিয়ায়।
- ২০২০ সালেও ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে তাপমাত্রা ৪ থেকে ৬ ডিগ্রি পর্যন্ত নেমেছিল।
- ২০২২ ও ২০২৩ সালেও প্রথম শৈত্যপ্রবাহ তেঁতুলিয়াতেই শুরু হয়েছিল।
- ২০২৪ সালের ডিসেম্বরেও সর্বনিম্ন ৮.৫ ডিগ্রি রেকর্ড হয়েছিল এখানেই।
স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন, তেঁতুলিয়ার ভৌগোলিক অবস্থান—হিমালয়ের পাদদেশ, উন্মুক্ত সবুজ মাঠ, নদী ও খালবিল মিলিয়ে এখানকার আবহাওয়া শীতের সময় তীব্র ঠান্ডা ধারণ করে।
শীত বাড়ায় প্রভাব পড়ছে স্থানীয় অর্থনীতিতে
পঞ্চগড়ের অর্থনীতি মূলত—
- চা শিল্প
- আলু ও সবজি চাষ
- ভারতে রপ্তানি
- পর্যটন
- দিনমজুরি নির্ভর শ্রম
- ইটভাটা
- সীমান্ত বাণিজ্য
—এই খাতগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।
শীত বাড়ায় এর মধ্যে কিছু খাতে ক্ষতি দেখা দিলেও কিছু খাতে বিপরীত চিত্রও দেখা যায়।
১. চা শিল্পে ভালো দিক
শীত বাড়লে পঞ্চগড়ের চা বাগানে পাতা কম ওঠে, তবে মান ভালো থাকে।
চায়ের দাম এক সময় বাড়তে থাকে।
২. পর্যটকের ভিড়
তেঁতুলিয়ার শীত উপভোগ করতে দেশের নানা জায়গা থেকে পর্যটকরা আসতে শুরু করেন।
বাংলাবান্ধা শিলাইহাটি, তিরনইহাট, মিনি পাহাড়—সব জায়গায় ভিড় বাড়ে।
৩. দিনমজুরদের সমস্যা
শীত যত বাড়ছে, সকালবেলার কাজের সুযোগ কমছে। এতে দৈনিক আয় কমে যাচ্ছে।
৪. সবজি ও আলুচাষে প্রভাব
অতিরিক্ত কুয়াশা পড়লে–
- আলুর জমিতে পচন
- পাতায় ছত্রাক
- সবজিতে দাগ
- বৃদ্ধিতে বাধা
–এই সমস্যা দেখা দিতে পারে।
স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়ছে
প্রচণ্ড ঠান্ডা ও আর্দ্রতার প্রভাবে—
- সর্দি
- কাশি
- নিউমোনিয়া
- হাঁপানি
- শিশুদের শ্বাসকষ্ট
- বয়স্কদের জ্বর
- রিউম্যাটিজম
ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা বাড়তে পারে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা ইতোমধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক রোগীর সংখ্যাই বেশি।
চিকিৎসকদের মতে—
“ঘন কুয়াশা ও ঠান্ডা বাতাস শিশুরা সহ্য করতে পারে না। উষ্ণ কাপড় ব্যবহার ও ভোরের ঘন কুয়াশায় বাইরে না যাওয়া জরুরি।”
শীত মোকাবিলায় স্থানীয়দের প্রস্তুতি
শীতের প্রকোপ বাড়তে শুরু করায় মানুষজন ইতোমধ্যেই—
- কম্বল
- সোয়েটার
- জ্যাকেট
- গরম কাপড়
- মাফলার
- হাতমোজা
ব্যবহার শুরু করেছে।
চা দোকান, ভাপা পিঠা, সুঁটকি ভাজা, স্যুপ—এ ধরনের খাবারের দোকানেও ভিড় বাড়ছে।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ বছর ডিসেম্বরের শুরুতেই শীত বাড়ায় গরম কাপড়ের চাহিদা বেড়ে গেছে।
শীতের প্রভাব দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও
শুধু তেঁতুলিয়া নয়—
- কুড়িগ্রামে তাপমাত্রা নেমেছে ১২.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে
- নওগাঁয় রেকর্ড হয়েছে ১২.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস
- রংপুরে কুয়াশা ঘন হয়ে পড়ছে
- ঢাকায়ও তাপমাত্রা কমে ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস এসেছে
আবহাওয়া অধিদপ্তরের মতে, ১০ ডিসেম্বরের পর শীত আরও বাড়তে পারে।
ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহেই প্রথম শৈত্যপ্রবাহের সম্ভাবনা রয়েছে।
পরবর্তী ৭ দিনের পূর্বাভাস
আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং আন্তর্জাতিক জরিপ অনুযায়ী পরবর্তী ৭ দিনে—
- তেঁতুলিয়ায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ থেকে ১২ ডিগ্রি থাকতে পারে
- কুয়াশা প্রতি দিন ভোরে ঘন হবে
- বাতাসের গতিবেগ বাড়বে
- হালকা থেকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ শুরু হতে পারে
- রাতে তাপমাত্রা দিনের তুলনায় দ্রুত কমবে
রাতের সময় শীতের তীব্রতা আরও বাড়বে বলে পূর্বাভাসে উল্লেখ করা হয়েছে।
ডিসেম্বরের শুরুতেই তেঁতুলিয়ায় শীতের যে কঠোরতা দেখা যাচ্ছে, তা পুরো দেশের জন্যই আগাম শীতের ইঙ্গিত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ঘন কুয়াশা, আর্দ্রতা এবং তাপমাত্রার দ্রুত পতন প্রমাণ করছে—উত্তরাঞ্চলে এ বছর শীত আরও তীব্র হতে পারে।
যানবাহন চলাচল থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনযাপন, শ্রমজীবী মানুষের কাজ—সব কিছুতেই এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
একই সঙ্গে পর্যটন, চা শিল্পের মতো কিছু খাতে ইতিবাচক প্রভাবও দেখা যেতে পারে।
মার্কিন আবহাওয়া প্রতিষ্ঠানের জরিপ এবং স্থানীয় আবহাওয়া অফিসের তথ্য একত্রে বলছে—
ডিসেম্বরের মধ্যভাগ থেকে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত দেশে দু’ধাপ শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে।
তেঁতুলিয়ার বাসিন্দারা তাই ইতোমধ্যে শীত মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
দেশের অন্যান্য এলাকাও প্রস্তুত হচ্ছে এক শীতল মৌসুমকে স্বাগত জানাতে।
MAH – 14110 I Signalbd.com



