আবহাওয়া

আবারো ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল বাংলাদেশ

Advertisement

বাংলাদেশ আবারো ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছে। বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫, বিকাল সোয়া ৪টার কিছু পর রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভূমিকম্পের কম্পন অনুভূত হয়। কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী এই কম্পনে মুহূর্তেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে। হঠাৎ দুলে ওঠা ভবন, নড়বড়ে অনুভূতি ও আশপাশের মানুষের হৈচৈ—সব মিলিয়ে নগরবাসীর মধ্যে স্বাভাবিকভাবে একটি উৎকণ্ঠার পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

ইউরোপীয়-ভূমধ্যসাগরীয় ভূকম্পন কেন্দ্র (ইএমএসসি) তাদের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের এই ভূমিকম্পের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। ভূমিকম্পটির অবস্থান, মাত্রা ও উৎসস্থল নিয়ে আরও তথ্য সংগ্রহ চলছে। প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই ভূমিকম্পটির কেন্দ্রস্থল ছিল বাংলাদেশের সীমান্তের কাছাকাছি অঞ্চলে অথবা দেশের উত্তর–পূর্ব দিকের সক্রিয় সিসমিক জোনে।

ভয়াবহতার আশঙ্কা না থাকলেও সতর্কতার জায়গা রয়েছে

প্রাথমিকভাবে কোনো বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। তবে দেশের বিভিন্ন স্থানে মানুষ আতঙ্কে বাড়িঘর ও অফিস থেকে বের হয়ে রাস্তায় নেমে আসে। ঢাকার মিরপুর, ধানমন্ডি, গুলশান, বাড্ডা, উত্তরা, ফার্মগেট, মগবাজার, মালিবাগ, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায়—বেশ স্পষ্টভাবেই কম্পন অনুভূত হয়। অনেকে জানান, তাদের বাসার জানালা, দরজা ও ফ্যান কেঁপে ওঠে।

চট্টগ্রামসহ উপকূলীয় অঞ্চলে কম্পন কিছুটা দুর্বল অনুভূত হলেও আতঙ্ক ছড়ানোর মতোই ছিল। সিলেট অঞ্চলের বাসিন্দারা বেশ জোরালোভাবে কম্পন টের পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। বিশেষ করে সিলেট দীর্ঘদিন ধরে ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত হওয়ায় সেখানকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক আরও বেশি।

নাগরিকদের অভিজ্ঞতা: কয়েক সেকেন্ডের কম্পনেই ভয় ছড়িয়ে পড়ে

ঢাকার বাড্ডার বাসিন্দা তারেক আহমেদ বলেন,
“আমি অফিসে বসে ছিলাম। হঠাৎ যেন চেয়ারটা ডানে-বামে দুলে উঠল। প্রথমে ভাবলাম মাথা ঘুরছে। পরে দেখি সবাই উঠে বাইরে দৌড়াচ্ছে।”

মিরপুরের এক গৃহিণী জানান,
“বাসায় রান্না করছিলাম, টের পেলাম চুলার ওপর হাঁড়ি নড়ে উঠছে। সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাদের নিয়ে নিচে নেমে আসি।”

সিলেটের শাহপরান এলাকার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী শিহাব উদ্দিন বলেন,
“কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও দোতলা পুরো কেঁপে উঠেছিল। সিলেট যেহেতু ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চল, তাই একটু কম্পনেই সবাই ভয় পায়।”

ইএমএসসি’র তথ্য: বাংলাদেশে ভূমিকম্প নিশ্চিত

ইউরোপীয়-ভূমধ্যসাগরীয় ভূকম্পন কেন্দ্র (ইএমএসসি) দ্রুতই তথ্য প্রকাশ করে জানায়—বাংলাদেশের উপরিভাগে বা সীমান্তে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। রিখটার স্কেলে প্রাথমিক মাত্রা পরে জানা যাবে, তবে এটি সাধারণত ৪ থেকে ৫।৫ মাত্রার মধ্যে হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

ইএমএসসি তাদের তথ্য আপডেট করতে সাধারণত স্থানীয় সময়, কেন্দ্রস্থল, গভীরতা এবং আশেপাশের দেশের অভিজ্ঞতা যুক্ত করে। তাদের ডেটাবেস অনুযায়ী, ২০২৫ সালে বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কয়েকবার মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় আজকের ভূমিকম্পটিও নতুন করে সতর্কবার্তা দিল।

**বাংলাদেশ কেন বারবার ভূমিকম্পে কাঁপছে?

ভূতত্ত্ববিদদের ব্যাখ্যা**

বাংলাদেশ ভূমিকম্পের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। কারণ বাংলাদেশের অবস্থান তিনটি বড় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে। এগুলো হলো—

১. ইন্ডিয়ান প্লেট
২. বার্মা প্লেট
৩. ইউরেশীয় প্লেট

এই প্লেটগুলোর সীমানায় নিয়মিত চাপ তৈরি হয় এবং সেই চাপের বিস্ফোরণই ভূমিকম্প।

বাংলাদেশ তিনটি প্রধান সিসমিক জোনে বিভক্ত—

সিসমিক জোন ১: সিলেট, চট্টগ্রাম, সুনামগঞ্জ, ময়মনসিংহ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি

সিসমিক জোন ২: ঢাকা, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদীসহ মধ্যাঞ্চল

সিসমিক জোন 3: দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের তুলনামূলক কম ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল

ঢাকা দ্বিতীয় উচ্চ-ঝুঁকির জোনে পড়ায় এখানে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পও বড় ক্ষতির সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে—বিশেষজ্ঞরা বহুদিন ধরে এই বিষয়ে সতর্ক করে আসছেন।

ইতিহাস বলছে—ভয়াবহ ভূমিকম্পের রেকর্ড রয়েছে

বাংলাদেশ ও এই অঞ্চলে আগেও একাধিক বড় ভূমিকম্প হয়েছে—

১৮৯৭ সালের মহাভূমিকম্প: সিলেট ও আসামের বিশাল এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞ
১৯১৮ সালের ভরদর ভূমিকম্প
১৯৫০ সালের আসাম ভূমিকম্প—৬ মাস ধরে আফটারশক
১৯৯৭ সালের চট্টগ্রাম ভূমিকম্প
২০০৪ সালের সুনামি উৎপত্তির বড় ভূমিকম্প
২০০৯, ২০১১, ২০১৬, ২০২১—সিলেট ও ঢাকায় একাধিক মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প
২০২৩ ও ২০২৪—ঢাকা ও চট্টগ্রামে কম্পন

অতএব আজকের ভূমিকম্পই বলে দিচ্ছে—বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকি এখনও কাটেনি।

**ভূমিকম্প কতটা শক্তিশালী ছিল?

প্রাথমিক বিশ্লেষণ**

সরকারি কর্তৃপক্ষ এখনো সুনির্দিষ্ট মাত্রা প্রকাশ না করলেও সাধারণত এই ধরনের অনুভূত ভূমিকম্পের বৈশিষ্ট্য—

৩.৮ – ৫.২ মাত্রা
গভীরতা ১০ – ৩০ কিলোমিটার
স্থায়িত্ব ৫ – ২০ সেকেন্ড

এই মাত্রার ভূমিকম্প সাধারণত বড় ধ্বংস তৈরি না করলেও, দুর্বল ভবনে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। বিশেষ করে ঢাকার মতো জনবহুল শহরে সামান্য কম্পনেও ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।

ঢাকায় ভবন ঝুঁকি: কেন আতঙ্ক বেশি?

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রকৌশল বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার ভবনগুলোর দুর্বলতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে—

• পুরনো ও অনিয়মিত নির্মাণ
• অপরিকল্পিত নগরায়ণ
• নরম মাটি
• বিধিমালা মানা না
• অবৈধ বাড়তি তলা

এই কারণে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পেও বড় ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। রাজধানীতে প্রায় ১০ লাখের বেশি ভবন রয়েছে, যার মধ্যে বেশ কয়েক লাখ ভবনই দুর্বল বলে বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন।

ভূমিকম্পে করণীয়: বিশেষজ্ঞদের জরুরি নির্দেশনা

ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কিত না হয়ে করণীয়গুলো জানা অত্যন্ত প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরা যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন—

ভূমিকম্পের সময় করণীয়:

• ভবনের বাইরে না গেলে ঘরের ভেতরই নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিন
• টেবিল বা মজবুত আসবাবের নিচে থাকুন
• জানালা, কাঁচ, আলমারি থেকে দূরে থাকুন
• লিফট ব্যবহার করবেন না
• গ্যাসের চুলা ও বৈদ্যুতিক সুইচ বন্ধ করার চেষ্টা করুন
• দরজা খোলা রাখুন যাতে বের হতে সমস্যা না হয়

ভূমিকম্পের পরে করণীয়:

• ভবনে ফাটল দেখা গেলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া প্রবেশ করবেন না
• গ্যাস লাইন ও বিদ্যুৎ সংযোগ পরীক্ষা করুন
• গুজবে কান দেবেন না
• কোনো ক্ষতি দেখলে স্থানীয় প্রশাসনকে জানাতে হবে

সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রস্তুতির গুরুত্ব

বিশেষজ্ঞরা বারবারই বলছেন—বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এ অবস্থায়—

• দুর্বল ভবনের তালিকা করা
• ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা ভাঙা
• রাজধানী ও বিভাগীয় শহরে ভূমিকম্প মহড়া
• দমকল, সিভিল ডিফেন্স, স্বাস্থ্যসেবা প্রস্তুত রাখা
• স্কুল-কলেজে ভূমিকম্প প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা

এসব জরুরি।

২০২১ সালের পর থেকে সরকার একাধিকবার ভূমিকম্প বিষয়ক সচেতনতা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, তবে সেগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে না পারলে বড় দুর্যোগের আশঙ্কা থেকেই যায়।

বিশেষজ্ঞ মত: বড় ভূমিকম্পের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের একজন অধ্যাপক বলেন—

“বাংলাদেশের প্লেট বাউন্ডারি হাজার বছর ধরে চাপ সঞ্চয় করছে। যে কোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। আজকের মতো মাঝারি কম্পনগুলো সেই বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাসও হতে পারে।”

বুয়েটের গবেষকরাও জানান—

“ঢাকা একটি নরম মাটির শহর—এখানে ৬ মাত্রার ভূমিকম্পও ভয়াবহ হতে পারে।”

মানুষের মধ্যে আতঙ্ক—কিন্তু সতর্কতাই প্রধান

আজকের ভূমিকম্পে আতঙ্ক ছড়ালেও এ পর্যন্ত কোনো বড় ক্ষতির খবর নেই। তবে বারবার ভূমিকম্প হওয়া—স্বাভাবিক ঘটনা নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি তলদেশীয় চাপ সক্রিয় হওয়ার লক্ষণ। এমন পরিস্থিতিতে জনগণের সচেতনতা ও সরকারি প্রস্তুতিই বড় দুর্দশা এড়াতে সাহায্য করতে পারে।

বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ—এটি এখন আর আলোচনার বিষয় নয়, বাস্তবতা। মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পও আমাদের প্রস্তুতির অদৃশ্য ঘাটতিগুলো সামনে নিয়ে আসে। ঢাকার মতো জনবহুল মহানগরীতে যে কোনো সময় একটি বড় ভূমিকম্প ঘটলে ক্ষয়ক্ষতি ভয়াবহ হতে পারে। তাই আজকের ভূমিকম্প আমাদের আরেকবার মনে করিয়ে দিল—প্রস্তুতিই একমাত্র পথ।

MAH – 14024 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button