ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুরে বৃহস্পতিবার ভোরে ৩.৫ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। স্থানীয় সময় সকাল ৫টা ৪২ মিনিটে এই কম্পন অনুভূত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো প্রাণহানি বা বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় ভূমিকম্প পর্যবেক্ষক সংস্থা ন্যাশনাল সেন্টার ফর সিসমোলজি (NCS) এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল মণিপুর রাজ্যের অভ্যন্তরে, তবে আশপাশের এলাকার মানুষও সামান্য কম্পন অনুভব করেছেন। ভূমিকম্পজনিত ঝুঁকি এড়াতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সাধারণ মানুষকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে।
মণিপুরে ভূমিকম্পের প্রভাব ও সতর্কতা
মণিপুরে ঘটা এই ভূমিকম্পটি খুব বড় না হলেও স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উত্তর-পূর্ব ভারত ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা। এর ফলে স্থানীয় প্রশাসন ভবিষ্যতের জন্য সতর্কতা বৃদ্ধি করেছে।
ভূমিকম্প সচেতনতা ও প্রস্তুতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ:
- প্রাণহানি রোধে জরুরি পরিকল্পনা: ঘরে বা কর্মস্থলে কোনো বিপদজনক বস্তু থেকে দূরে থাকা।
- স্থাপত্য ও অবকাঠামো: ভূমিকম্প-সহনীয় স্থাপনা নির্মাণ এবং পুরনো ভবন ও ব্রিজের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ।
- জরুরি যোগাযোগ: কম্পনের সময় সরকারি জরুরি হটলাইন ও স্থানীয় সেবা ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত থাকা।
ভুটান ও বঙ্গোপসাগরে সাম্প্রতিক ভূকম্পন
মণিপুরের কম্পনের মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে ভুটানে রাত ১১টা ৩২ মিনিটে ৩.০ মাত্রার ভূমিকম্প রেকর্ড হয়। একই রাত বঙ্গোপসাগরে রাত ২টা ৫৯ মিনিটে ৪ মাত্রার কম্পন অনুভূত হয়, যার কেন্দ্রস্থল প্রায় ১০ কিলোমিটার গভীরে।
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বঙ্গোপসাগরে এই কম্পন সাধারণত সামুদ্রিক অঞ্চলে খুব ক্ষুদ্র ক্ষতি করে। তবে কোনও মাছধরা বা সমুদ্রযান যারা গভীর সমুদ্রে থাকে, তাদের জন্য সতর্কতা অবলম্বন করা গুরুত্বপূর্ণ।
ইন্দোনেশিয়ায় শক্তিশালী ভূমিকম্প
এদিনই ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের কাছে সুমাত্রা দ্বীপে ৬.৩ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প রেকর্ড হয়। ভূ-পৃষ্ঠের মাত্র ১০ কিলোমিটার গভীরে এই কম্পন তৈরি হওয়ায় পাশের শহরগুলোতে কম্পন অনুভূত হয়েছে। যদিও বড় ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ বা প্রাণহানি ঘটেনি।
এর প্রায় কয়েক ঘণ্টা আগে ইন্দোনেশিয়ার নর্থ সুলাওয়েসি অঞ্চলে ৫.১ মাত্রার ভূমিকম্প নথিভুক্ত হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় একাধিক ভূমিকম্পের কারণে এলাকাবাসীকে পুনরায় সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, ভুটান, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইনসহ দেশগুলোতে প্রায়ই স্বল্প ও মাঝারি মাত্রার কম্পন অনুভূত হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতামত:
- ভূ-প্রকৌশল ও অবকাঠামো: ভূমিকম্প-সহনীয় ভবন নির্মাণে জোর দেওয়া উচিত।
- জরুরি প্রণালী: সরকারী ও স্থানীয় জরুরি ব্যবস্থাপনা প্রণালীর নিয়মিত চর্চা প্রয়োজন।
- সচেতনতা বৃদ্ধি: স্কুল, কলেজ এবং কর্মস্থলে ভূমিকম্প-সচেতনতা কর্মসূচি চালানো জরুরি।
ভূমিকম্পের মাত্রা যতই কম হোক, তবু প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে আগে থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সাধারণ মানুষ কীভাবে নিরাপদ থাকবে
প্রাথমিক কম্পনের সময় সচেতন থাকার কয়েকটি উপায়:
- মেঝেতে বা শক্ত কাঠামোর নিচে আশ্রয় নেওয়া।
- উচ্চ স্থানে না থাকা, জানালা বা কাঁচের পাশে না থাকা।
- বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখা জরুরি।
- দূর্ঘটনার সময় বাইরে বেরোলে খোলা স্থান বেছে নেওয়া।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সাধারণ সতর্কতা গ্রহণ করলে প্রাণহানি ও বড় ক্ষয়ক্ষতি রোধ করা সম্ভব।
মণিপুরের ভূমিকম্পের প্রেক্ষাপট
মণিপুর, অসম, নাগাল্যান্ড ও মিজোরামের মতো উত্তর-পূর্ব ভারতীয় রাজ্যগুলো ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলে পড়ে।
- ভূ-প্রকৌশল বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, এই অঞ্চলগুলোতে টেকটনিক প্লেটের ক্রিয়াশীলতা বেশি।
- প্রায় প্রতি বছরই এখানে ৩ থেকে ৫ মাত্রার কম্পন রেকর্ড হয়।
- বড় ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে ধ্বংসযজ্ঞ এড়াতে সরকারি পর্যবেক্ষণ ও প্রস্তুতি জরুরি।
সমুদ্রপৃষ্ঠ ও দ্বীপাঞ্চলে কম্পনের প্রভাব
বিশেষ করে বঙ্গোপসাগর, সুমাত্রা ও আন্ডামান সাগরের দ্বীপাঞ্চলগুলোতে ভূকম্পনের প্রভাবে সামুদ্রিক জীবন ও মানুষদের জন্য ঝুঁকি থাকে।
- মাছ ধরার নৌকা, পর্যটক এবং জলযান চলাচলকারী সবাইকে সতর্ক থাকতে বলা হয়।
- কম্পনের মাত্রা ৪-এর বেশি হলে সামুদ্রিক অঞ্চলে সুনামি সতর্কতা জারি করা হতে পারে।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ
নর্থ সুলাওয়েসি, আচেহ, মণিপুর এবং বঙ্গোপসাগরসহ বিভিন্ন অঞ্চলের কম্পন আন্তর্জাতিক ভূমিকম্প পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলো নিয়মিত মনিটর করে।
- USGS এবং ISC এর তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভূমিকম্পের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে।
- বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্পের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতের ঝুঁকি অনুমান করা যায়।
সতর্কতার জন্য সরকারের দিক নির্দেশনা
স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় সরকার, বিশেষ করে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অথরিটি, ইতিমধ্যেই মণিপুর ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় সতর্কতা জারি করেছে।
- স্কুল, কলেজ ও অফিসগুলোতে জরুরি প্রস্তুতি কর্মসূচি চালানো।
- রাস্তা, ব্রিজ ও বড় স্থাপনার নিয়মিত মেরামত ও পর্যবেক্ষণ।
- স্থানীয় মানুষদের ভূমিকম্প সচেতনতা প্রশিক্ষণ প্রদানের উদ্যোগ।
সাধারণ মানুষকে মূল পরামর্শ
- আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক ও সজাগ থাকা।
- জরুরি ফোন নাম্বার এবং স্থানীয় উদ্ধারকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা।
- শিশু ও বৃদ্ধদের বিশেষভাবে নিরাপদ স্থানে রাখা।
- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপ্রমাণিত খবর থেকে দূরে থাকা।
মণিপুরে বৃহস্পতিবার ভোরের কম্পন, ভুটান ও বঙ্গোপসাগরে প্রাকৃতিক কম্পনের ঘটনার পাশাপাশি ইন্দোনেশিয়ার শক্তিশালী ভূমিকম্প আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভূমিকম্পে সজাগ থাকা এবং প্রস্তুতি রাখা অপরিহার্য।
বিশেষজ্ঞরা একমত, প্রাকৃতিক দুর্যোগ রোধে প্রযুক্তি, সচেতনতা ও সরকারের উদ্যোগের সমন্বয় জরুরি। মণিপুরে অনুভূত কম্পন ক্ষুদ্র হলেও এটি একটি সতর্কবার্তা হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।
MAH – 14020 I Signalbd.com



