আবহাওয়া

মধ্যরাতে বঙ্গোপসাগরে ভূমিকম্প, ৪ মাত্রার কম্পনে কাঁপল টেকনাফ

Advertisement

বঙ্গোপসাগরের গভীরে সৃষ্ট হালকা মাত্রার ভূমিকম্পে মধ্যরাতে দুলে ওঠে কক্সবাজারের টেকনাফ। বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) রাত ৩টা ২৯ মিনিটে অনুভূত এই ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৪.০। টেকনাফ উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১১৮ কিলোমিটার দূরে এর উৎপত্তি। যদিও কম্পনের মাত্রা অল্প ছিল, তবুও গভীর রাতে বিছানা কেঁপে ওঠায় সীমান্ত এলাকার কিছু বাসিন্দা আতঙ্কিত হয়ে জেগে ওঠেন।

আন্তর্জাতিক ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ সংস্থা ভলকানো ডিসকভারি জানায়, কম্পনের তীব্রতা খুবই কম থাকায় বেশিরভাগ মানুষ এটি টের পাননি। অন্যদিকে ইউরোপীয়-মেডিটেরানিয়ান সিসমোলজিক্যাল সেন্টার (ইএমএসসি) জানায়, ভূমিকম্পটির উৎপত্তি ছিল পৃথিবীর ১০ কিলোমিটার গভীরে। গভীরতা ভিন্নভাবে দেখালেও দুটি সংস্থাই নিশ্চিত করেছে যে এটি বঙ্গোপসাগরের টেকটনিক সক্রিয় এলাকার কম্পন।

টেকনাফে কয়েকজন স্থানীয় জানান, রাতের নিস্তব্ধতায় প্রথমে মনে হয়েছিল বাতাসে কোনো অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে। পরে বিছানা সামান্য দুলে উঠলে তারা বুঝতে পারেন এটি ভূমিকম্প।

টেকনাফ ও কক্সবাজার অঞ্চলে কেন বাড়ছে ভূমিকম্প?

বিশেষজ্ঞদের মতে, পুরো কক্সবাজার–টেকনাফ উপকূলীয় অঞ্চলটি একটি সক্রিয় প্লেট বাউন্ডারির ওপর অবস্থিত। ভারতীয় প্লেট পূর্ব দিকে সরে গিয়ে মায়ানমার প্লেটের নিচে ঢুকে যাচ্ছে (Subduction Zone)। এই প্রক্রিয়াকে “টেকটনিক কনভার্জেন্স” বলা হয়, যা বড় ধরনের ভূমিকম্প সৃষ্টির মূল কারণ।

বাংলাদেশের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভূমিকম্প অঞ্চলগুলো:

  1. চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-টেকনাফ উপকূলীয় বেল্ট
  2. ঢাকা-ময়মনসিংহ টানেল অঞ্চলের ফল্ট লাইন
  3. সিলেট-দাউকি ফল্ট
  4. বঙ্গোপসাগরীয় মেগাথ্রাস্ট অঞ্চল

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ অঞ্চলে মধ্যম ও ক্ষুদ্র মাত্রার বহু কম্পন রেকর্ড করা হয়েছে, যা ভবিষ্যতে বড় কম্পনের সম্ভাবনা ইঙ্গিত করছে বলে মনে করছেন ভূকম্পবিদরা।

সাম্প্রতিক ধারাবাহিক কম্পন বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা বাড়িয়েছে

টির ঠিক এক সপ্তাহ আগেই বাংলাদেশ কেঁপে উঠেছিল ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের উত্তর–মধ্যাঞ্চলে অনুভূত হয় শক্তিশালী ওই কম্পন, যেখানে অন্তত ১০ জন প্রাণ হারান এবং কয়েকশ মানুষ আহত হন। নরসিংদী এলাকায় উৎপত্তি হওয়া সেই ভূমিকম্প ছিল সাম্প্রতিক বছরের অন্যতম শক্তিশালী ভূকম্পন।

ভূমিকম্প শুরু হতেই ঢাকার বহুতল ভবনগুলোতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, মানুষ বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। অনেক ভবনে চিড় ধরা, দেয়াল ফেটে যাওয়া, সিঁড়িতে ভিড়—সব মিলিয়ে এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধারাবাহিকভাবে ঘন ঘন ছোট–মাঝারি কম্পন বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস হতে পারে, যদিও সবসময় এটি নিশ্চিত নয়। তারপরও ঝুঁকি বাড়ছে—এ কথা তারা স্পষ্টভাবে বলছেন।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশটি বর্তমানে একটি “হাই সিসমিক অ্যাক্টিভ জোন”-এ অবস্থান করছে। ভূগর্ভে চাপ জমতে থাকলে যে কোনো সময় বড় কম্পন ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষত বঙ্গোপসাগরীয় প্লেটে কয়েক দশক ধরে শক্তি জমে আছে, যা মুক্তি পেলে বড় ধরনের সুনামি সৃষ্টির ঝুঁকিও রয়েছে।

বঙ্গোপসাগরীয় ভূমিকম্পের ইতিহাস ভয়াবহ

বঙ্গোপসাগর ও আরাকান সাবডাকশন জোনে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ইতিহাস বহু পুরনো। আন্তর্জাতিক গবেষণা অনুযায়ী—

১৭৬২ সালের আরাকান ভূমিকম্প (মাত্রা ৮.৫+)

  • দক্ষিণ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও মিয়ানমারে বিশাল ক্ষতি
  • সমুদ্র উঁচু হয়ে উপকূলীয় এলাকায় সুনামি–সদৃশ জলোচ্ছ্বাস
  • ভূমিধস ও ভূমির উচ্চতা পরিবর্তন

বাংলাদেশের দক্ষিণাংশে বহু প্রাচীন স্থাপনা এখনো সেই ভয়াবহ ভূকম্পনের ক্ষতচিহ্ন বহন করে।

গবেষকদের মতে, এর পর থেকে এ অঞ্চলে একই মাত্রার বড় কোনো ভূমিকম্প হয়নি। অর্থাৎ টেকটনিক শক্তি জমে আছে, যা ভবিষ্যতে বিপদ বাড়াতে পারে।

ভূমিকম্পের গভীরতা কেন গুরুত্বপূর্ণ?

ভূমিকম্পের মাত্রা (Magnitude) যেমন গুরুত্বপূর্ণ, গভীরতাও (Depth) সমান গুরুত্বপূর্ণ।
কারণ—

  • ১০ কিলোমিটারের কম গভীরতায় ভূমিকম্প হলে তা বেশি তীব্রভাবে অনুভূত হয়
  • গভীর ভূমিকম্পে কম ক্ষতি হলেও প্রযুক্তিগতভাবে তা বিপজ্জনক সংকেত দিতে পারে
  • বঙ্গোপসাগরের সাবডাকশন এলাকায় সাধারণত অগভীর ভূমিকম্পই বেশি

ইএমএসসি ও অন্যান্য সংস্থা যে ১০ কিলোমিটার গভীরতার কথা বলছে, তা নির্দেশ করে—এ অঞ্চলটি বর্তমানে সক্রিয় হয়ে উঠছে।

ঢাকায় বড় ভূমিকম্প হলে কী হতে পারে?—বিস্তারিত বিশ্লেষণ

বাংলাদেশের রাজধানী বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভূমিকম্প–প্রবণ মহানগরগুলোর একটি। কারণ—

  1. ঘনবসতি
  2. অননুমোদিত বহুতল ভবন
  3. জরুরি সেবার অভাব
  4. পুরান ঢাকার দুর্বল ভবন কাঠামো
  5. সঠিক ভূকম্পীয় কোড অনুযায়ী নির্মাণ না হওয়া

২০১৯ সালের একটি আন্তর্জাতিক গবেষণায় বলা হয়েছিল—ঢাকায় ৬.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ৭০% ভবন আংশিক বা সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

সাম্প্রতিক ৫.৭ মাত্রার কম্পন রাজধানীতে বড় ক্ষতি না করলেও বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন—এটি বড় দুর্যোগের একটি সতর্ক ঘণ্টা।

বঙ্গোপসাগরের নিম্নচাপ, আগ্নেয়গিরি কার্যক্রম এবং কম্পন—বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ

বঙ্গোপসাগর শুধু ভূমিকম্প নয়, আগ্নেয়গিরি সৃষ্ট টেকটনিক উত্তাপেরও একটি সম্ভাব্য কেন্দ্র। ভারতীয় মহাসাগরের নিচে “হটস্পট” বা আগ্নেয়গিরি–সদৃশ ভূ-তাপীয় অঞ্চল রয়েছে বলে একাধিক গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে।

এ কারণে—

  • সাগরের তলদেশে ফাটল সৃষ্টি
  • বারবার সূক্ষ্ম কম্পন
  • গভীর ভূ-তাপীয় বুদবুদ
  • সাবডাকশন জোনে চাপ বৃদ্ধি

এসব মিলেই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বঙ্গোপসাগরকে “উদ্বেগজনক সক্রিয় অঞ্চল” হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

টেকনাফের মানুষের অভিজ্ঞতা: “রাতের নীরবতায় হঠাৎ বিছানা কেঁপে উঠল”

টেকনাফ পৌরসভার এক বাসিন্দা বলেন—

“রাতে হালকা শব্দের মতো অনুভব হচ্ছিল। তারপর হঠাৎ বিছানা সামান্য দুলে ওঠে। প্রথমে বুঝতে পারিনি, পরে বুঝলাম ভূমিকম্প। কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হলেও ঘুম ভেঙে যায়।”

টেকনাফ স্থলবন্দর এলাকার এক প্রহরী জানান, তিনি পাহারায় ছিলেন, তখন মাটিতে অল্প কম্পন অনুভব করেন। তবে ভবন দুলে ওঠার মতো তীব্রতা ছিল না।

ভূমিকম্পে ঘরবাড়ি নিরাপদ রাখতে কী করবেন?

বিশেষজ্ঞরা কিছু জরুরি করণীয় তুলে ধরেছেন—

ভূমিকম্পের সময়:

  • দরজার ফ্রেম বা শক্ত টেবিলের নিচে আশ্রয় নিন
  • লিফট ব্যবহার করবেন না
  • বহুতল ভবনে থাকলে সিঁড়ি ব্যবহার করুন
  • মাথা ও ঘাড় হাত দিয়ে ঢেকে রাখুন
  • কাঁচের জানালা, ফ্রিজ, বুকশেলফ থেকে দূরে থাকুন

ভূমিকম্পের আগে:

  • ভবনের শক্তি পরীক্ষা করুন
  • দেয়াল–কলামের ফাটল সারান
  • ফার্নিচার দেয়ালে আটকে রাখুন
  • জরুরি ব্যাগ প্রস্তুত রাখুন
  • পরিবারে “সেফটি প্ল্যান” তৈরি করুন

বঙ্গোপসাগরের সাম্প্রতিক ভূমিকম্পগুলোর তালিকা (শেষ কয়েক মাস)

১. এপ্রিল ২০২৫ — ৪.১ মাত্রা
২. জুন ২০২৫ — ৩.৯ মাত্রা
৩. আগস্ট ২০২৫ — ৪.৩ মাত্রা
৪. সেপ্টেম্বর ২০২৫ — ৫.০ মাত্রা
৫. নভেম্বর ২০২৫ (ঢাকা) — ৫.৭ মাত্রা
৬. নভেম্বর ২০২৫ (টেকনাফ) — ৪.০ মাত্রা

বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের ধারাবাহিক কম্পন ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক সংকেত।

বঙ্গোপসাগরে মধ্যরাতের ভূমিকম্পটি মাত্রায় ছোট হলেও এর গুরুত্ব কম নয়। কারণ—

  • এ অঞ্চলটি বর্তমানে অত্যন্ত সক্রিয়
  • প্লেট-চাপ বাড়ছে
  • সাম্প্রতিক কয়েকটি মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প গভীর উদ্বেগের বিষয়
  • বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই বিশ্বের অন্যতম উচ্চ–ঝুঁকিপূর্ণ ভূমিকম্প অঞ্চলে পরিণত হয়েছে

সাধারণ মানুষের আতঙ্কে ভোগার প্রয়োজন না থাকলেও সতর্ক থাকা এবং প্রস্তুত থাকা এখন সময়ের দাবি।

বিশেষজ্ঞরা একটাই কথা জোর দিয়ে বলছেন—
“প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঠেকানো সম্ভব নয়, কিন্তু প্রস্তুতি থাকলে ক্ষয়ক্ষতি বহু কমানো যায়।”

MAH – 14010 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button