আবহাওয়া

আগামী এক সপ্তাহে আরও ২০টি ভূমিকম্প হতে পারে

Advertisement

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে টানা দুটি দিনের ভূমিকম্প দেশের মানুষের মধ্যে নতুন উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি কোনো সাধারণ কম্পন নয়। বরং সামনের দিনগুলোতে আরও বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার পূর্বাভাস দিচ্ছে সাম্প্রতিক নড়াচড়া। আগামী এক সপ্তাহে আরও ২০ বার ভূমিকম্প হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মেহেদি আহমেদ আনসারী।

শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক গবেষণাতেও উঠে এসেছে যে, বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে একটি গোপন মেগাথার্স্ট ফল্ট বিস্তৃত রয়েছে, যা ৯ মাত্রা পর্যন্ত ভয়াবহ ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে সক্ষম। এমন সতর্কবার্তা এসেছে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকম্প গবেষণা কেন্দ্রের সাম্প্রতিক অধ্যয়ন থেকে।

বাংলাদেশ ভূমিকম্পের বিষয়ে ভূতাত্ত্বিকভাবে অত্যন্ত স্পর্শকাতর অবস্থানে আছে। কেননা, ভারত, ইউরেশিয়া ও বার্মা — এই তিনটি বিশাল টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশ অবস্থিত। প্লেটগুলো এখন আটকে থাকা অবস্থান থেকে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে, যা বড় কম্পনের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে আরও।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে—সাম্প্রতিক এই কম্পনগুলো আসলে কী ইঙ্গিত দিচ্ছে? বাংলাদেশের জন্য সামনে কী ধরনের ঝুঁকি অপেক্ষা করছে? এবং বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?

সপ্তাহজুড়ে আরও ২০টি ভূমিকম্প হতে পারে

বুয়েটের অধ্যাপক মেহেদি আহমেদ আনসারী জানান,
“মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে চারবার অনুভূত ভূমিকম্প হয়েছে। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—আগামী এক সপ্তাহে আরও ২০টি কম্পন হতে পারে। এর মধ্যে মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়তে পারে। এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা সম্ভব নয়। কিছুদিন পর্যবেক্ষণ জরুরি।”

তিনি আরও জানান, সাম্প্রতিক সব কম্পনের উৎপত্তিস্থল নিয়ে বহু তথ্য প্রচার হলেও প্রকৃত উৎপত্তিস্থল নরসিংদী এলাকা

তার ভাষায়,
“উৎপত্তিস্থল ভিন্ন ভিন্ন বলা হলেও বাস্তবে একই অঞ্চলে কম্পন হচ্ছে। যদি ৫ দশমিক ৭ মাত্রার চেয়েও বড় ভূমিকম্প হয়, তাহলে অল্প সময়েই ভয়াবহ দুর্যোগের শঙ্কা তৈরি হবে।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের দল নেমেছে মাঠে: মাটির ফাটল থেকে নমুনা সংগ্রহ

নরসিংদীর ঘোড়াশাল এলাকায় সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের পর মাটিতে বড় ধরনের ফাটলের সৃষ্টি হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের একটি সাত সদস্যের টিম সেখানে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত স্থান থেকে মাটির নমুনা সংগ্রহ করেছে।

বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আ স ম ওবায়দুল্লাহ বলেন,
“নমুনা পরীক্ষা করে বোঝা যাবে—কোন ধরনের কম্পন হয়েছে, কত গভীরে উৎপত্তি, এবং ভূকম্পনের প্রকৃতি কী।”

এ ধরনের ফাটল সাধারণত ভূগর্ভস্থ শক্তির নির্গমন বা মাটির স্তরের দ্রুত সরে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

৯ মাত্রার ভূমিকম্পের সম্ভাবনা—কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় উদ্বেগ

২০১৬ সালে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় বলা হয়—গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার নিচে বিশাল এক মেগাথার্স্ট ফল্ট লুকিয়ে আছে। পুরু পললস্তরের নিচে বিস্তৃত এ ফল্ট বহু বছর ধরে শক্তি জমাচ্ছে। এটি সক্রিয় হলে ম্যাগনিটিউড ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে।

গবেষণায় তুলে ধরা হয়:

  • দুইটি প্লেটের সাবডাকশন জোন বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে গেছে
  • পললস্তরের নিচে লুকানো ফল্টটি বহু বছর ধরে নীরবে শক্তি জমাচ্ছে
  • এই অঞ্চলে বড় ভূমিকম্প হলে প্রভাব পড়বে পুরো দক্ষিণ এশিয়ায়

এ ধরনের মেগাথার্স্ট ভূমিকম্প পৃথিবীতে খুব কমই ঘটে, তবে যেগুলো ঘটে সেগুলো ভয়াবহ ধ্বংস ডেকে আনে, যেমন:

  • ২০০৪ সালের সুনামি (৯.১ মাত্রা)
  • ২০১১ সালের জাপানের সুনামি (৯.০ মাত্রা)

বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই গবেষণা বাংলাদেশের ভূমিকম্প বাস্তবতায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ সৈয়দ হুমায়ুনের সতর্কতা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন,
“আমরা ২০১৬ সাল থেকে বলে আসছি—এ অঞ্চলে বড় ভূমিকম্পের সম্ভাবনা বাড়ছে। প্লেট আটকে থাকা অবস্থা থেকে সরে যেতে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক কম্পনগুলো বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাসও হতে পারে।”

তিনি আরও বলেন:
“সিলেট থেকে টেকনাফ পর্যন্ত যে প্লেট সংযোগস্থল বিস্তৃত, সেটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক। গত এক হাজার বছরে সেখানে জমে থাকা শক্তি বের হয়নি।”

দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল আরও ঝুঁকিতে: ১৭৬২ সালের কম্পনের স্মৃতি

কক্সবাজার–মিয়ানমার অঞ্চলের ফল্ট লাইনে ১৭৬২ সালে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। প্রায় ৮.৫ মাত্রার ওই কম্পনে:

  • সেন্টমার্টিন দ্বীপ তিন মিটার ওপরে উঠে আসে
  • ডুবন্ত দ্বীপটি ভূপৃষ্ঠে দৃশ্যমান হয়
  • বঙ্গোপসাগরে সুনামি হয়
  • ৫০০ মানুষের মৃত্যু ঘটে

বিশেষজ্ঞরা জানান, সেই শক্তি নিঃসরণ হলেও ওই অঞ্চল আবারও নতুন শক্তি সঞ্চয় করছে। অর্থাৎ ভবিষ্যতে সেখান থেকেও বড় ভূমিকম্প হতে পারে।

টেকটোনিক প্লেটের নড়াচড়া: কেন বাংলাদেশ এত ঝুঁকিতে?

বাংলাদেশ একাধারে তিনটি বড় প্লেটের মিলনস্থলে অবস্থিত:

  1. ভারতীয় প্লেট
  2. ইউরেশীয় প্লেট
  3. বার্মা প্লেট

এ প্লেটগুলো একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষ বা ঘর্ষণ করলে সৃষ্টি হয়:

  • ভূমিকম্প
  • পর্বত সৃষ্টি
  • নতুন চ্যুতি
  • মাটির ভাঙন

হিমালয়ের নিচের প্লেটগুলো যেভাবে সরে যাচ্ছে, তা দক্ষিণ এশিয়ায় ভূমিকম্পের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

একই কারণে:

  • নেপাল ২০১৫ সালে বড় কম্পনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়
  • ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল নিয়মিত ভূমিকম্প অনুভব করে
  • মিয়ানমারও উচ্চ সিসমিক জোন

এই পুরো সিসমিক বেল্টের মাঝখানেই বাংলাদেশ অবস্থিত।

রিং অব ফায়ার–এর সঙ্গে তুলনা: সাবডাকশন জোন সবচেয়ে বিপজ্জনক

বিশেষজ্ঞরা জানান, সাবডাকশন জোনে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্প সবচেয়ে ভয়াবহ হয়। কারণ শক্তির পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। প্রশান্ত মহাসাগরের চারদিকে বিস্তৃত “রিং অব ফায়ার” অঞ্চলটি সাবডাকশন জোনের জন্যই পরিচিত—এখানে হওয়া অধিকাংশ ভূমিকম্পই ৭.৫ মাত্রার ওপরে।

বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলেও একই ধরণের সাবডাকশন জোন রয়েছে। এ কারণেই ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা এ অঞ্চলকে “উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ সিসমিক অঞ্চল” বলে উল্লেখ করেন।

ভূমিকম্প বাড়লে কী হতে পারে?

সাম্প্রতিক কম্পনের ধরণ ও বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী:

  • বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস হতে পারে
  • প্লেটের আটকানো শক্তি বেরিয়ে আসার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে
  • পুনরাবৃত্ত ভূমিকম্প বাড়লে ঝুঁকি দ্রুত বাড়ে
  • ঢাকার ভবনগুলো পুরনো ও অনিয়মিত হওয়ায় বিপর্যয় আরও ভয়াবহ হতে পারে

ঢাকা বিশ্বের ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। তাই বড় কম্পন হলে—

  • ভবন ধস
  • গ্যাসলাইন বিস্ফোরণ
  • সড়ক ধ্বংস
  • বিদ্যুৎ বিভ্রাট
  • উদ্ধার সীমিত হওয়া

এসব মিলিয়ে বড় মানবিক বিপর্যয় ঘটতে পারে।

পরিস্থিতি মূল্যায়নে আরও গবেষণা প্রয়োজন

বিশেষজ্ঞরা বলেন, সামনে কী ঘটতে পারে তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন:

  • স্যাটেলাইট ডাটা
  • জিপিএস ট্র্যাকিং
  • ভূগর্ভস্থ শক্তি মাপার প্রযুক্তি
  • নিয়মিত সিসমিক মনিটরিং

বাংলাদেশে ভূমিকম্প গবেষণায় এখনও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা থাকলেও ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে।

জনসচেতনতা এবং প্রস্তুতি—এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূমিকম্প প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। তবে ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন:

  • ভূমিকম্প-সহনশীল ভবন নির্মাণ
  • পুরনো ভবন সংস্কার
  • জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি
  • মানুষের সচেতনতা
  • নিয়মিত মহড়া
  • সঠিক পরিকল্পনা

বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্পের সম্ভাবনা নতুন নয়। তবে সাম্প্রতিক কম্পনগুলো এই সম্ভাবনাকে আরও সামনে এনেছে।

বাংলাদেশ এখন এমন একটি অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে যেখানে ভবিষ্যতের যেকোনো সময় বড় ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। আন্তর্জাতিক গবেষণা, দেশি বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ এবং সাম্প্রতিক কম্পনের ধরণ—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। আগামী সপ্তাহে ২০টি পর্যন্ত কম্পনের আশঙ্কা থাকায় সতর্কতা নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।

MAH – 13931 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button