আবহাওয়া

ভূমিকম্পের পর এবার ধেয়ে আসছে ‘ঘূর্ণিঝড়’

Advertisement

গত দুই দিনে দেশে বারবার ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ায় যখন জনমনে চরম আতঙ্ক, ঠিক তখনই বঙ্গোপসাগরে একটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আবহাওয়া ও জলবায়ু গবেষকরা এই বিষয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছেন। গবেষকদের মতে, আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে এই ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ উপকূলের মধ্যবর্তী যেকোনো স্থানে আঘাত হানতে পারে।

শনিবার (২২ নভেম্বর) সন্ধ্যায় কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ এবং বাংলাদেশ ওয়েদার অবজারভেশন টিম (বিডব্লিউওটি)-এর মতো পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলো এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। ভূ-কম্পনের পরপরই ঘূর্ণিঝড়ের এই পূর্বাভাস দেশের দুর্যোগ পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।

ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি ও শক্তি সঞ্চয়ের প্রক্রিয়া

আবহাওয়াবিদদের তথ্য অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি।

লঘুচাপের সৃষ্টি: সর্বশেষ পূর্বাভাস অনুসারে, আগামী ২৫ থেকে ২৬ নভেম্বর নাগাদ দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগর (আন্দামান ও নিকবার দ্বীপের দক্ষিণ পাশে) একটি লঘুচাপ সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশ ওয়েদার অবজারভেশন টিম (বিডব্লিউওটি) জানিয়েছে, এই লঘুচাপটি মালাক্কা প্রণালী ও তৎসংলগ্ন এলাকায় তৈরি হয়েছে।

নিম্নচাপ ও ঘনীভবন: এই লঘুচাপটি পর্যায়ক্রমে নিম্নচাপ, গভীর নিম্নচাপ ও সর্বশেষে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা করা হচ্ছে। অনুকূল পরিবেশ পেলে ২৫-২৭ নভেম্বরের মধ্যে এটি গভীর নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে।

শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে রূপ: আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ বলছে, ঘনীভূত হয়ে এই সিস্টেমটি ২৮-২৯ নভেম্বরের মধ্যে মধ্য ও পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগরে পৌঁছাতে পারে এবং তখন এটি একটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ঘূর্ণিঝড়টির সম্ভাব্য নাম হতে পারে ‘সেনিয়ার’।

উপকূলে আঘাতের সম্ভাব্য সময় ও স্থান

এই সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশের জন্য কতটা বিপজ্জনক হবে, তা নির্ভর করছে এর গতিপথ ও তীব্রতার ওপর।

আঘাতের সময়: সর্বশেষ আবহাওয়া পূর্বাভাস অনুসারে, ঘূর্ণিঝড়টি আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বরের মধ্যে উপকূলে আঘাত করতে পারে।

সম্ভাব্য আঘাতের স্থান: সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়টি ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য থেকে শুরু করে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম উপকূলের মধ্যবর্তী যে কোনো স্থানের ওপর দিয়ে উপকূলে আঘাত করার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

তবে আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন, পরিবেশ অনুকূলে থাকলে ঘূর্ণিঝড়টি দিক পরিবর্তন করে উত্তর বা উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এখনই আঘাতের সুনির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণ করা সম্ভব নয়; আগামী কয়েক দিনের পর্যবেক্ষণের পর এ বিষয়ে আরও স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।

ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস

এই সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বাংলাদেশে একটি বৃষ্টিবলয় সক্রিয় হতে পারে।

বৃষ্টির সময়কাল: গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ জানিয়েছেন, ৩০ নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসের ৫ তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশের ওপরে হালকা থেকে মাঝারি মানের বৃষ্টিপাতের প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।

বৃষ্টির তীব্রতা: বিডব্লিউওটি জানিয়েছে, বৃষ্টিবলয়টি ৩০ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বরের মধ্যে সক্রিয় হতে পারে এবং তা দুই থেকে তিন দিন স্থায়ী হতে পারে। প্রাথমিক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের তুলনায় দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বৃষ্টির তীব্রতা বেশি হতে পারে।

এই সময়ে হালকা বৃষ্টি হলেও তা কৃষিকাজ এবং সাধারণ জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলতে পারে।

আবহাওয়া গবেষকের সতর্কতা: “সর্বশেষ আবহাওয়া পূর্বাভাস অনুসারে সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়টি ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য থেকে শুরু করে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম উপকূলের মধ্যবর্তী যে কোনো স্থানের ওপর দিয়ে উপকূলে আঘাত করার আশঙ্কা করা যাচ্ছে আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসের ৪ তারিখ এর মধ্যে।”

কৃষক ও জেলেদের জন্য জরুরি পরামর্শ

এই ঘূর্ণিঝড় এবং বৃষ্টির আশঙ্কার কারণে কৃষি ও সমুদ্রগামী পেশাজীবীদের জন্য জরুরি সতর্কতা ও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে:

কৃষকদের জন্য: ডিসেম্বর মাসের ১ তারিখ থেকে ৫ তারিখ পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের আশঙ্কার কথা মাথায় রেখে জমিতে থাকা পাকা আমন ধান কাটা ও মাড়াই করা ৩০ নভেম্বরের মধ্যেই শেষ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। শীতকালীন শাক-সবজি চাষিরা সম্ভাব্য এই বৃষ্টিপাতের কথা মাথায় রেখে বীজ বোনা ও জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে পারেন।

জেলেদের জন্য: আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলো জানিয়েছে, নভেম্বর মাসের ২৮ তারিখের পর থেকে উত্তর বঙ্গোপসাগরের সমুদ্র উত্তাল হওয়া শুরু করার আশঙ্কা করা যাচ্ছে। সমুদ্রগামী জেলেদের ৩০ নভেম্বরের মধ্যে উপকূলে ফেরার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। ২৯ নভেম্বরের পরে নতুন করে সমুদ্রে মাছ ধরতে না যাওয়ার জন্য কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে।

পর্যটন ক্ষেত্রে প্রভাব ও সতর্কতা

সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়ের কারণে দেশের জনপ্রিয় পর্যটন এলাকাগুলোতেও সতর্কতা জারি করা হয়েছে। বিশেষ করে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ভ্রমণকারীদের জন্য বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে।

সেন্ট মার্টিনে সতর্কতা: আবহাওয়া পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ২৮ তারিখের পর থেকে উত্তর বঙ্গোপসাগরের সমুদ্র উত্তাল হওয়া শুরুর আশঙ্কা করা যাচ্ছে। ৩০ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত টেকনাফ ও সেন্ট মার্টিন দ্বীপের মধ্যবর্তী সমুদ্র প্রচণ্ড উত্তাল থাকার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে এই সময়ে পর্যটন-সম্পর্কিত ভ্রমণ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

ভূমিকম্পের আতঙ্কের পর এই ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কতা পর্যটন ব্যবসায়ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

দ্বিমুখী দুর্যোগের মোকাবিলা

ভূমিকম্পের ধারাবাহিক আতঙ্কের মধ্যেই বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের এই পূর্বাভাস দেশের জন্য দ্বিমুখী প্রাকৃতিক দুর্যোগের ইঙ্গিত দিচ্ছে। সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড় ‘সেনিয়ার’ যদি সত্যি শক্তিশালী রূপে উপকূলে আঘাত হানে, তবে তা উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটাতে পারে। এই পরিস্থিতিতে দুর্যোগ মোকাবিলায় জাতীয় প্রস্তুতি জোরদার করা জরুরি। সরকারকে আবহাওয়ার গতি-প্রকৃতির ওপর নিবিড় নজর রাখা, উপকূলীয় অঞ্চলে প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া এবং সাধারণ জনগণের কাছে দ্রুত ও সঠিক তথ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটি কার্যকর যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। বিশেষত, কৃষক ও জেলেদের জন্য প্রদত্ত সতর্কতাগুলো কঠোরভাবে অনুসরণ করা আবশ্যক।

এম আর এম – ২৩৩২,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button