আবহাওয়া

ঘূর্ণিঝড় ‘মোন্থা’র মন্থর গতির প্রভাবে আজও বৃষ্টির সম্ভাবনা

Advertisement

ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ উপকূলে আঘাত হেনে দুর্বল হয়ে পড়া প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোন্থা’ এখনও তার প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। যদিও ঘূর্ণিঝড়টির শক্তি এখন অনেকটা ক্ষীণ, তবু এর অবশিষ্ট প্রভাবে আজ বৃহস্পতিবারও দেশের বিভিন্ন স্থানে হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর (বিএমডি)

‘মোন্থা’ কোথায় এবং কী অবস্থায় আছে এখন?

আবহাওয়া অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় ‘মোন্থা’ গতকাল (বুধবার) রাতে ভারতের ছত্তিশগড় রাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলে নিম্নচাপ আকারে অবস্থান করছিল। এটি ধীরে ধীরে উত্তর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আবহাওয়াবিদদের ভাষায়, “মোন্থা এখন আর প্রবল ঘূর্ণিঝড় নয়, তবে এর অবশিষ্টাংশের প্রভাবে বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ওডিশা, ঝাড়খণ্ডসহ পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোতে এখনও বৃষ্টি হচ্ছে।”

আজ সকালে রাজধানী ঢাকায় আকাশ ছিল রৌদ্রোজ্জ্বল। তবে সকাল সাড়ে ৯টার পর থেকেই ঘন মেঘে আকাশ ঢেকে যায়। সকাল সোয়া ১০টার সময় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আকাশ মেঘলা এবং বাতাস ছিল আর্দ্রতায় ভরপুর। অনেক এলাকাতেই হালকা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি দেখা গেছে।

রাজধানীসহ চার বিভাগে বৃষ্টির সম্ভাবনা

আবহাওয়াবিদ মো. হাফিজুর রহমান বলেন, “আজ ঢাকায় বৃষ্টি হতে পারে। ইতিমধ্যেই আশপাশের এলাকায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। পাশাপাশি রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা বিভাগেও বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। এই বৃষ্টিগুলো মূলত ঘূর্ণিঝড় ‘মোন্থা’র অবশিষ্ট প্রভাবের ফল।”

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, আজকের পরও বৃষ্টি সম্পূর্ণভাবে থামবে না। বিচ্ছিন্নভাবে আগামীকাল শুক্রবার ও পরশু শনিবারও দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টি হতে পারে। তবে রোববার থেকে আবহাওয়া ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে যাবে এবং বৃষ্টি কমে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

শুধু ‘মোন্থা’ নয়, আরব সাগরেও নিম্নচাপের প্রভাব

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধুমাত্র ঘূর্ণিঝড় মোন্থার প্রভাবে বৃষ্টি হচ্ছে এমন নয়। একই সময়ে আরব সাগরেও একটি নিম্নচাপ সক্রিয় রয়েছে, যা ভারত ও বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে আর্দ্রতা বৃদ্ধি করছে। ফলে দুই দিকের প্রভাব মিলে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বৃষ্টি হচ্ছে।

এছাড়া, দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর থেকে আসা বাতাসের স্যাঁতস্যাঁতে ভাবও বৃষ্টিপাতের কারণ হিসেবে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা।

বৃষ্টির পর তাপমাত্রা কমবে

বৃষ্টি শেষ হওয়ার পর দেশের তাপমাত্রা কিছুটা কমে আসতে পারে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে রাতের তাপমাত্রা কমবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ফলে শীতের আগমনী বার্তা ধীরে ধীরে অনুভূত হতে পারে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই।

হাফিজুর রহমান বলেন, “আগামী সপ্তাহে তাপমাত্রা ২-৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমতে পারে। নভেম্বরের শুরুতে হালকা শীতের অনুভূতি পাওয়া যেতে পারে।”

ঘূর্ণিঝড় ‘মোন্থা’ কীভাবে তৈরি হয়েছিল?

ঘূর্ণিঝড় ‘মোন্থা’ তৈরি হয় বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে। প্রায় এক সপ্তাহ আগে সাগরে একটি গভীর নিম্নচাপ সৃষ্টি হলে সেটি ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। পরে এটি উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ উপকূলে আঘাত হানে।

ঘূর্ণিঝড়টি যখন স্থলভাগে প্রবেশ করে, তখন সর্বোচ্চ বাতাসের গতি ছিল প্রতি ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত। তবে স্থলভাগে ঢোকার পর শক্তি হারিয়ে এটি দ্রুতই দুর্বল হয়ে পড়ে।

কৃষিতে প্রভাব: সুবিধা ও আশঙ্কা

বৃষ্টি বাংলাদেশের কৃষিখাতে মিশ্র প্রভাব ফেলতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান মৌসুমে আমন ধান, শীতকালীন সবজি ও রবি ফসলের জন্য এই বৃষ্টি কিছুটা উপকারী হতে পারে। এতে জমিতে আর্দ্রতা বাড়বে এবং আগাম ফসল রোপণে সহায়তা করবে।

তবে একটানা বৃষ্টি হলে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতার আশঙ্কা থেকে যায়, যা সবজি চাষে ক্ষতির কারণ হতে পারে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ইতিমধ্যে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সতর্ক করেছে যেন অতিবৃষ্টির কারণে কোনো জমিতে পানি জমে না থাকে।

শহরাঞ্চলে জনদুর্ভোগের আশঙ্কা

ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনা শহরের বেশ কয়েকটি এলাকায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় অল্প বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। ইতিমধ্যেই রাজধানীর কিছু এলাকায় রাস্তায় পানি জমতে শুরু করেছে।
ঢাকার কাওরানবাজার, মালিবাগ, মিরপুর ও শ্যামলীতে বৃষ্টির পর যানজটের আশঙ্কা রয়েছে। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বৃষ্টি চলাকালে ড্রেন পরিষ্কার ও পানি নিষ্কাশনের কাজ জোরদার করা হবে

জনসাধারণের জন্য সতর্কতা

আবহাওয়া অধিদপ্তর জনসাধারণকে সতর্ক থেকে চলাফেরার পরামর্শ দিয়েছে। বিশেষ করে সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল, নদীপথ ও খোলা জায়গায় অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।

মৎস্য ও নৌযান চলাচলের জন্য নির্দেশনা:
ছোট নৌকা ও ট্রলারগুলোকে উপকূলের কাছাকাছি অবস্থান করতে বলা হয়েছে। গভীর সাগরে কোনো জাহাজ বা ট্রলারকে যেতে নিষেধ করা হয়েছে যতক্ষণ না সাগর শান্ত হয়।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ঘূর্ণিঝড়ের বৃদ্ধি

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বেড়েছে এবং ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এ ধরনের ঘূর্ণিঝড় দ্রুত গঠিত হচ্ছে এবং বেশি ক্ষয়ক্ষতি করছে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে বঙ্গোপসাগরে গঠিত প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এর মধ্যে ‘আমফান’, ‘ইয়াস’, ‘সিত্রাং’, এবং সাম্প্রতিক ‘মোন্থা’ উল্লেখযোগ্য।

ভবিষ্যতের জলবায়ু চিত্র

বিশেষজ্ঞদের মতে, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়টি বাংলাদেশের শীতকাল হলেও জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়ার স্বাভাবিক ধারা কিছুটা বিঘ্নিত হচ্ছে। ফলে শীতের সময় কমে যাচ্ছে এবং বৃষ্টির ধরণেও পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।

বাংলাদেশে জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. রেজাউল করিম বলেন, “আগে অক্টোবরের শেষে আকাশ পরিষ্কার হয়ে যেত, এখন নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত বৃষ্টি থাকে। এটি জলবায়ু পরিবর্তনেরই প্রতিফলন।”

‘মোন্থা’ গেলেও প্রভাব রয়ে গেছে

যদিও ঘূর্ণিঝড় ‘মোন্থা’ আর প্রবল নয়, এর প্রভাব এখনো দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যমান। বৃষ্টি কমে এলেও আর্দ্রতা ও তাপমাত্রার পরিবর্তনে পরিবেশে তার উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে।
আগামী সপ্তাহে আবহাওয়া স্বাভাবিক হয়ে এলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বঙ্গোপসাগরে নতুন নিম্নচাপ তৈরি হতে পারে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে, যা নজরে রাখছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

MAH – 13548 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button