আবহাওয়া

গভীর নিম্নচাপ রূপ নিলো ঘূর্ণিঝড়ে, ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত

Advertisement

দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপটি ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করে এখন ঘূর্ণিঝড় “মোন্থা” তে রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর সোমবার (২৭ অক্টোবর ২০২৫) সকালে এক বিশেষ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। ইতোমধ্যে দেশের চারটি প্রধান সমুদ্রবন্দরে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত জারি করা হয়েছে।

আবহাওয়াবিদ এ কে এম নাজমুল হক স্বাক্ষরিত ৫ নম্বর বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় ‘মোন্থা’ বর্তমানে দক্ষিণপশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন দক্ষিণপূর্ব বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থান করছে। এর কেন্দ্র এখন ১১ দশমিক ৭ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৫ দশমিক ৫ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থান করছে।

ঘূর্ণিঝড় ‘মোন্থা’র বর্তমান অবস্থান

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সোমবার রাত ৩টার পর ঘূর্ণিঝড়টি

  • চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে প্রায় ১৩৬০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে,
  • কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ১৩০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে,
  • মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ১২৮০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে,
  • এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ১২৬০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল।

এটি পশ্চিম-উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আরও ঘণীভূত হতে পারে বলে জানানো হয়েছে।

বাতাসের গতিবেগ ও সাগরের অবস্থা

ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার, যা দমকা বা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বেগে প্রবাহিত হচ্ছে।
এই এলাকায় সাগর বর্তমানে অত্যন্ত উত্তাল, ঢেউয়ের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বাতাসে ঘূর্ণির প্রভাব বাড়ছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস।

সতর্ক সংকেত ও নির্দেশনা

ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উপকূলীয় এলাকাগুলোর জন্য ইতোমধ্যে ১ নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেত নামিয়ে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত জারি করা হয়েছে।
এর আওতায় এসেছে—

  • চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর
  • কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর
  • মোংলা সমুদ্রবন্দর
  • পায়রা সমুদ্রবন্দর

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে এবং গভীর সাগরে না যাওয়ার জন্য কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় ‘মোন্থা’ কোথায় যাচ্ছে?

বর্তমান পূর্বাভাস অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড়টি আরও পশ্চিম-উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ উপকূল অতিক্রম করতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, এটি ২৮ অক্টোবর (মঙ্গলবার) সন্ধ্যা বা রাতে ওই উপকূল অতিক্রম করবে।

তবে বাংলাদেশ উপকূলে এর সরাসরি প্রভাব পড়ার আশঙ্কা না থাকলেও, সাগর উত্তাল থাকায় ও বাতাসের বেগ বৃদ্ধি পাওয়ায় সতর্কতা বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছে সংশ্লিষ্ট দপ্তর।

“মোন্থা” নামের অর্থ কী?

ঘূর্ণিঝড়টির নামকরণ করেছে মিয়ানমার। “মোন্থা” শব্দটি স্থানীয় একটি ফুলের নাম। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (WMO) এবং ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তর (IMD)-এর নিয়ম অনুযায়ী, উত্তর ভারত মহাসাগরে সৃষ্ট প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ের নাম সদস্য দেশগুলোর প্রস্তাবিত তালিকা থেকে নির্ধারিত হয়।
এই নামের তালিকায় বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, ইরান, মালদ্বীপ, ইয়েমেনসহ ১৩টি দেশ অংশ নেয়।

ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সম্ভাব্য আবহাওয়া পরিবর্তন

যদিও ঘূর্ণিঝড়টি ভারতের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, তবুও এর প্রভাবে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে কিছু প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষ করে,

  • উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালী, ভোলা, বরগুনা, বাগেরহাট, খুলনা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে সাময়িক বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
  • ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও মেঘলা আকাশ ও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি দেখা যেতে পারে।
  • বাতাসের গতিবেগ বৃদ্ধি ও জোয়ারের উচ্চতা বাড়ার কারণে কিছু এলাকায় জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা রয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, চাঁদের প্রভাব ও ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উপকূলীয় জেলাগুলোতে স্বাভাবিকের চেয়ে ২-৩ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে।

জেলেদের জন্য বিশেষ নির্দেশনা

বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড ইতোমধ্যে উপকূলজুড়ে জরুরি সতর্কতা জারি করেছে
জেলেদের বলা হয়েছে,

  • আগামী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত গভীর সাগরে না যেতে,
  • উপকূলীয় ঘাট বা নিরাপদ আশ্রয়ে নৌযান বেঁধে রাখতে,
  • এবং স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশনা কঠোরভাবে মেনে চলতে

এর পাশাপাশি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্বেচ্ছাসেবক দলগুলোকে সতর্কবার্তা প্রচার ও প্রস্তুতি জোরদারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

উপকূলীয় জনগণের প্রস্তুতি

ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পড়ার আশঙ্কায় ইতোমধ্যে উপকূলের কিছু জেলায় ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসরত জনগণকে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।
স্থানীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি জানিয়েছে—

  • আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে,
  • প্রয়োজনীয় খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও চিকিৎসা সহায়তার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে,
  • এবং স্থানীয় প্রশাসন ঘূর্ণিঝড়ের গতিবিধি ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ করছে

পূর্বের ঘূর্ণিঝড় থেকে শিক্ষা

বাংলাদেশ প্রতিবছর গড়ে ৪-৫টি ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবের মুখে পড়ে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যেমন—

  • ২০২৩ সালে ঘূর্ণিঝড় মোখা,
  • ২০২৪ সালে ঘূর্ণিঝড় রেমাল
    উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটায়।
    তবে এবার সরকারের আগাম সতর্কতা ও প্রযুক্তিনির্ভর পূর্বাভাস ব্যবস্থার কারণে ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ঘূর্ণিঝড় ‘মোন্থা’ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত

জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা সাধারণের চেয়ে বেশি থাকায় এ বছর ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির সম্ভাবনা বেড়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান বলেন—

“বঙ্গোপসাগরের উষ্ণ জলরাশি ঘূর্ণিঝড়কে শক্তি জোগায়। তাই এখনকার ‘মোন্থা’ ঘূর্ণিঝড়ও দ্রুত ঘণীভূত হচ্ছে। সৌভাগ্যক্রমে এটি বাংলাদেশের দিকে নয়, বরং ভারতের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।”

তিনি আরও বলেন,

“তবুও আমাদের উপকূলীয় এলাকার মানুষকে সচেতন থাকতে হবে। কারণ ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ঢেউ, জলোচ্ছ্বাস ও হঠাৎ বৃষ্টির ঝুঁকি থেকেই যায়।”

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরবর্তী বার্তা

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথ, শক্তি ও সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে পরবর্তী বিশেষ বিজ্ঞপ্তি নিয়মিত প্রকাশ করা হবে।
সাধারণ জনগণকে অফিসিয়াল আপডেট ছাড়া গুজবে বিশ্বাস না করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় ‘মোন্থা’ বর্তমানে বঙ্গোপসাগরে সক্রিয় হলেও বাংলাদেশের সরাসরি আঘাতের আশঙ্কা আপাতত নেই। তবে সাগর উত্তাল থাকায় ও বায়ু প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সতর্কতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরামর্শ অনুযায়ী, জেলেদের গভীর সাগরে না যাওয়া, জনগণের সচেতন থাকা এবং প্রশাসনের নির্দেশ মেনে চলাই নিরাপত্তার মূল চাবিকাঠি।

বাংলাদেশ সরকার, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড ও স্থানীয় প্রশাসন ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়েছে।
সবাই যদি সতর্ক থাকে, তবে এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে— ঠিক যেমন অতীতে আমরা বহু দুর্যোগ জয় করেছি।

MAH – 13496 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button