
ভারতের গাজলডোবা ব্যারেজের সবগুলো গেট খুলে দেওয়ায় উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার বহু ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। ইতিমধ্যেই রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারি, কুড়িগ্রামসহ কয়েকটি জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
রবিবার গভীর রাতে আচমকাই ভয়াল রূপ নিল তিস্তার পানি। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কোমর সমান পানিতে তলিয়ে গেল নদীর দুপাড়ের শত শত বসতবাড়ি, বিদ্যালয়, ফসলের ক্ষেত ও মাছের ঘের। রাতভর আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ ছোটাছুটি করে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজ করেছেন। কারও মাথায় শিশু, কারও হাতে চাল–ডাল–আলু ভর্তি হাঁড়ি, আবার কারও হাতে শীতের একটুকরো কম্বল—যা বাঁচানো সম্ভব তাই নিয়ে দলে দলে ছুটেছেন আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে।
তিস্তার দুকূলে অচলাবস্থা
ডালিয়া ব্যারেজ পয়েন্টে পানির প্রবল স্রোত সামাল দিতে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ৪৪টি জলকপাটই খুলে দিয়েছে। তবুও কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না পানি। বরং ব্যারেজের পূর্ব পাশে ফ্লাড বাইপাসের ওপর দিয়েও স্রোত বইছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এভাবে পানি বাড়তে থাকলে যেকোনো মুহূর্তে বাইপাসটি ভেঙে যেতে পারে, আর তা হলে ক্ষতির মাত্রা হবে ভয়াবহ।
পানিবন্দি জনজীবন
লালমনিরহাট, নীলফামারি, রংপুর ও কুড়িগ্রামের বিশাল এলাকা এখন পানিবন্দি। হাজার হাজার মানুষ গবাদিপশু নিয়ে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। গ্রামীণ সড়কগুলো তলিয়ে যাওয়ায় যান চলাচল একেবারেই বন্ধ হয়ে পড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পানি ঢুকে পড়ায় পাঠদান বন্ধ রয়েছে। অনেক পরিবার গাছের মাচা কিংবা উঁচু রাস্তার পাশে অস্থায়ী আশ্রয় নিয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক
তিস্তা অববাহিকার কৃষকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের জমির আমন ধান, ভুট্টা ও শাকসবজি মুহূর্তেই ডুবে গেছে। ক্ষেতের পাশে থাকা মাছের ঘের ও পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। অনেক কৃষক জানাচ্ছেন, এই ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।
আবহাওয়া ও পানির মাত্রা
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিংয়ে ২৬১ মিলিমিটার, কোচবিহারে ১৯০ মিলিমিটার, জলপাইগুড়িতে ১৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। একই সময়ে গ্যাংটক, অরুণাচলসহ উজান এলাকায় ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়েছে। বাংলাদেশের ভেতরে পঞ্চগড়ে ১১৮ মিলিমিটার, ডালিয়ায় ৮৫ মিলিমিটার, কুড়িগ্রামের পাটেশ্বরীতে ৭৬ মিলিমিটার ও রংপুরে ২৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। ফলে উজানের ঢল ও স্থানীয় বৃষ্টির মিলিত প্রভাবে তিস্তার পানি বিপৎসীমার অনেক ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ মোস্তাফিজার রহমান জানিয়েছেন, আগামী ২৪ ঘণ্টায়ও রংপুর বিভাগ ও উজানের ভারতীয় অঞ্চলগুলোতে ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে।
প্রশাসনের সতর্কতা ও ত্রাণ কার্যক্রম
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে রংপুর বিভাগের কমিশনার শহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, ইতোমধ্যেই জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং করে মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। উঁচু স্থানে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও চিকিৎসা সহায়তা পৌঁছে দেওয়া শুরু হয়েছে।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পানিবন্দি পরিবারগুলোকে দ্রুত উঁচু স্থানে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে এবং তাদের জন্য চাল, ডাল, বিস্কুট ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
অতীতের বন্যার স্মৃতি
তিস্তা নদীতে বর্ষাকালে বন্যা নতুন নয়। তবে এবারের পানি বৃদ্ধি হঠাৎ করেই তীব্র আকার ধারণ করেছে। স্থানীয়রা বলছেন, ২০১৭ সালের বন্যার পর এমন ভয়াবহ অবস্থা আর দেখা যায়নি। সে সময় কয়েক হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বর্তমান পরিস্থিতি যদি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে না আনা যায়, তবে ক্ষতির পরিমাণ আরও ভয়াবহ হবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
স্থানীয়দের অভিজ্ঞতা
নীলফামারীর এক ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক আব্দুল কুদ্দুস জানান, “হঠাৎ রাতের বেলা পানি এসে সবকিছু তলিয়ে দিল। বাড়ির ভেতর এখন কোমর পানি। গরুগুলোকে কোনোভাবে বাঁচিয়ে রাস্তার উঁচু জায়গায় রেখেছি। জমির সব ধান শেষ হয়ে গেল।”
লালমনিরহাটের গৃহবধূ রাবেয়া খাতুন বলেন, “আমরা রাতেই বাচ্চাদের নিয়ে বের হয়ে আসি। কিছু জামাকাপড় আর চাল–ডাল নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছি। কিন্তু কতদিন এখানে থাকতে হবে জানি না।”
বিশেষজ্ঞ মতামত
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তরাঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহসান হাবিব বলেন, “উজানে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে হঠাৎ করে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা ব্যারেজের সব কপাট খুলে দিয়েছি। তবুও পানি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। পরিস্থিতি সামাল দিতে এখন আমাদের প্রধান কাজ হচ্ছে মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া।”
পরিবেশবিদরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উত্তরাঞ্চলে হঠাৎ বন্যার ঝুঁকি আরও বেড়েছে। আগাম সতর্কতা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন ছাড়া এই বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব নয়।
সামনের দিনগুলোতে ঝুঁকি
আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী, যদি বৃষ্টি অব্যাহত থাকে, তাহলে তিস্তার পাশাপাশি ব্রহ্মপুত্র, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানিও বিপৎসীমার ওপরে প্রবাহিত হবে। এতে আরও বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আগামী এক সপ্তাহ এই অঞ্চলের মানুষের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সময়।
তিস্তার ভাঙন, পাহাড়ি ঢল ও আকস্মিক বন্যা উত্তরবঙ্গের মানুষের জন্য দীর্ঘদিনের আতঙ্ক। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। রাতারাতি গৃহহীন হয়ে পড়েছেন হাজারো মানুষ। সামনে কতো বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে, তার সঠিক উত্তর এখনো কেউ জানেন না। তবে প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, সর্বোচ্চ সতর্ক থেকে প্রাণহানি ঠেকানোই এখন প্রধান লক্ষ্য।
MAH – 13181 I Signalbd.com