রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন চলতি আগস্টের শেষ ভাগে ভারত সফরে আসছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। এমন সময়ে এই সফরের খবর এলো যখন দক্ষিণ এশিয়া ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলছে। ভারত, রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্কের টানাপোড়েনের প্রেক্ষাপটে পুতিনের এই সফরকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সফরের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এবং প্রাথমিক তথ্য
ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল জানান, প্রেসিডেন্ট পুতিনের ভারত সফর প্রায় নিশ্চিত। যদিও নির্দিষ্ট তারিখ প্রকাশ করা হয়নি, তবে রুশ বার্তা সংস্থা সূত্র জানায়, আগস্টের শেষ সপ্তাহেই এই সফর হতে পারে।
দোভাল বলেন, “ভারত ও রাশিয়ার সম্পর্ক বহু পুরনো এবং বিশেষ। আমরা এই সম্পর্কের ধারাবাহিকতাকে গুরুত্ব দিই। প্রেসিডেন্ট পুতিনের সফর উভয় দেশের জন্যই লাভজনক হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।”
রাশিয়া-ভারত সম্পর্ক: এক দীর্ঘ ইতিহাস
ভারত ও রাশিয়ার সম্পর্ক বহু দশকের পুরনো। স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকেই দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিল গভীর। বর্তমানে ভারতের প্রতিরক্ষা খাতে রাশিয়ার প্রভাব এখনো বিশাল। যুদ্ধবিমান থেকে শুরু করে সাবমেরিন পর্যন্ত বহু সামরিক সরঞ্জাম ভারত রাশিয়া থেকেই আমদানি করে থাকে।
সম্প্রতি ভারত রাশিয়া থেকে তেল আমদানি বৃদ্ধি করেছে, বিশেষ করে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পরেও। এই পদক্ষেপে যুক্তরাষ্ট্রের অসন্তুষ্টি প্রকাশ পেলেও ভারত তার কৌশলগত স্বার্থে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখছে।
সময়টা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
এই সফর এমন একটি সময় হতে যাচ্ছে যখন আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ রাশিয়ার ওপর একাধিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে। এদিকে ভারত, এই যুদ্ধ নিয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখেছে এবং রাশিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার করেছে।
পাশাপাশি, চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বর্তমানে বেশ জটিল। লাদাখ সীমান্তে উত্তেজনা অব্যাহত রয়েছে। এমন সময়ে পুতিনের ভারত সফর কেবল দ্বিপাক্ষিক নয়, বরং ত্রিপাক্ষিক এবং বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটেও গুরুত্বপূর্ণ।
সফরে কী কী আলোচনা হতে পারে?
বিশ্লেষকদের মতে, প্রেসিডেন্ট পুতিনের সফরে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আলোচনা হতে পারে:
- জ্বালানি চুক্তি: তেলের আমদানি ও মূল্য নির্ধারণ নিয়ে নতুন চুক্তি হতে পারে।
- প্রতিরক্ষা সহযোগিতা: যৌথ সামরিক মহড়া, অস্ত্র আমদানি ও প্রযুক্তি হস্তান্তর বিষয়েও আলোচনা হতে পারে।
- আঞ্চলিক নিরাপত্তা: আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং দক্ষিণ এশিয়ায় নিরাপত্তা নিয়ে রাশিয়ার ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা হতে পারে।
- বাণিজ্য সম্প্রসারণ: রুপিতে লেনদেন এবং বিকল্প ব্যাংকিং ব্যবস্থার দিকেও নজর দেওয়া হতে পারে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ
ভারত-রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতায় যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে অসন্তোষ জানিয়েছে। বিশেষ করে রাশিয়া থেকে ডিসকাউন্ট মূল্যে তেল কেনায় দিল্লির প্রতি ওয়াশিংটনের দৃষ্টিভঙ্গি বেশ কঠোর। যুক্তরাষ্ট্রের মতে, এমন পদক্ষেপ রাশিয়ার অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এড়াতে সাহায্য করছে।
তবে ভারত বরাবরের মতোই তার পররাষ্ট্রনীতিতে “অটোনমি” বজায় রাখার কথা বলছে। দেশটির মতে, জাতীয় স্বার্থে ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতি বজায় রাখা জরুরি।
পুতিনের সফরের প্রভাব: রাজনৈতিক ও কৌশলগত বিশ্লেষণ
এই সফর ভারতকে নতুন করে একটি গ্লোবাল প্লেয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করতে পারে। রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা চীন ও পাকিস্তানের জন্য কৌশলগত বার্তা হতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই সফরের মধ্য দিয়ে ভারত বিশ্বকে বোঝাতে চাইছে যে, তারা কারো প্রভাবাধীন নয় এবং নিজস্ব নীতিতে চলতে সক্ষম। পশ্চিমা শক্তিগুলোর চাপে থেকেও ভারত তার পুরনো বন্ধু রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখছে।
অতীতে এমন সফর কী ফল বয়ে এনেছে?
পুতিন শেষবার ভারতে এসেছিলেন ২০২১ সালে। তখনো প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্য নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এবারও তেমন কিছু বড় সিদ্ধান্ত আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ ইতিমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন, ভারত ও রাশিয়া আগামী দিনগুলোতে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে চায়, বিশেষ করে ব্রিকস এবং সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার মতো প্ল্যাটফর্মে।
ভারতের অবস্থান কতটা জোরালো?
বিশ্ব রাজনীতিতে ভারতের অবস্থান এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া — এই তিন পরাশক্তির সঙ্গেই ভারতে যোগাযোগ রয়েছে। পুতিনের সফর সেই ভারসাম্য রক্ষার কৌশলে নতুন মাত্রা যোগ করবে বলেই ধারণা করছেন পর্যবেক্ষকরা।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভবিষ্যতে এই সফর দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। তবে শেষ পর্যন্ত সফরের ফল কতটা কার্যকর হবে, তা নির্ভর করবে উভয় দেশের সিদ্ধান্ত এবং বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়ার ওপর।
এম আর এম – ০৭৩৫, Signalbd.com



