আবহাওয়া

বিশ্বের প্রথম আধুনিক রাজধানী কাবুল এখন সম্পূর্ণ পানিহীন হওয়ার পথে

Advertisement

কাবুলের পানিসংকট: জলবায়ু পরিবর্তন ও অপরিকল্পিত নগরায়নের মিলিত দুঃসহ পরিণতি

আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল, যা এক সময় ছিল আধুনিকতার নিদর্শন, এখন দাঁড়িয়ে রয়েছে ভয়ংকর এক পানিহীন সংকটের মুখে। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার একত্রিত হয়ে কাবুলকে নিয়ে যাচ্ছে এক অবিস্মরণীয় জলজ সংকটে। মার্সি কর্পস, সিএনএন নিউজ ও ইউনিসেফসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, কাবুল শীঘ্রই হতে যাচ্ছে বিশ্বের প্রথম আধুনিক রাজধানী যার ভূগর্ভস্থ পানি সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়ে যাবে।

কাবুলের দৈনন্দিন জীবন জলহীনতার শিকার

সূর্যোদয়ের সাথে সাথে কাবুলের পাহাড়ি অঞ্চলগুলোয় শুরু হয় পানির জন্য মরিয়া সংগ্রাম। ৪২ বছর বয়সী রাহিলা এবং তার চার সন্তান প্রতিদিন পানির ট্যাঙ্কার আসার অপেক্ষায় রাস্তায় দাঁড়ান, ভাঙা বালতি ও জেরিক্যানে পানি ভর্তি করার জন্য। রাহিলা জানিয়েছেন, “আমাদের কাছে নিরাপদ পানীয় জলের কোনো উৎস নেই। পানির অভাবে আমাদের জীবনযাত্রা অচল।”

রাহিলার মত অনেক আফগান পরিবার প্রতিদিন কয়েক কিলোমিটার পথ পায়ে হাঁটেন পানির জন্য, আবার অনেকে বেশি দামী দামেও পানির উৎস কিনতে বাধ্য হন।

ভূগর্ভস্থ পানির হ্রাস ও দূষণ: সংকটের গভীরতা

মার্সি কর্পসের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কাবুল শহরের ৫০% নলকূপ ইতিমধ্যে শুকিয়ে গেছে। প্রতি বছর প্রাকৃতিক পুনঃভরণ হার থেকে প্রায় ৪৪ মিলিয়ন কিউবিক মিটার বেশি পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। যার ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বিপজ্জনকভাবে নিচে নামছে।

তাছাড়া শহরের ভূগর্ভস্থ পানি দূষিত হচ্ছে পিট ল্যাট্রিন, শিল্পবর্জ্য এবং বর্জ্য জল মিশ্রণের কারণে। এটি স্বাস্থ্য সংকটের মাত্রা বাড়িয়েছে। শহরে ডায়রিয়া, বমি ও অন্যান্য জলজ ব্যাধি সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি কর্মচারী সৈয়দ হামিদ জানিয়েছেন, “আমরা এমনকি পানির মাধ্যমে দাঁত মাজলেও অসুস্থ হয়ে পড়ি।”

জলবায়ু পরিবর্তন ও জলসম্পদের ওপর এর প্রভাব

কাবুলের বিশেষজ্ঞ পানি বিজ্ঞানী নাজিবুল্লাহ সাদিদ বলেন, “যদিও বৃষ্টি বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু শীতকালে তুষারপাত কমে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির পূর্ণতা হচ্ছে না। অতিরিক্ত বৃষ্টি ফ্ল্যাশ ফ্লাডের কারণ হচ্ছে, যা পানির রিচার্জকে বাধাগ্রস্ত করছে।”

বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় আফগানিস্তানের জলবায়ু ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি খরা, উচ্চ তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাতের অনিয়মিততা এবং বন্যার কারনে পানির নিরাপদ সরবরাহ এখন এক বড় চ্যালেঞ্জ।

কাবুলের বাসিন্দাদের জীবনযাত্রায় পানির সংকটের প্রভাব

২৮ বছর বয়সী আহমদ ইয়াসিন তার পরিবারের জন্য বাড়ির পিছনে ১২০ মিটার গভীর একটি কূপ খনন করেছেন, কিন্তু পানির গুণগত মান এতটাই খারাপ যে, পরিবার পানি ফুটিয়ে পান করছে। ইয়াসিন বলেন, “আমাদের এই পানি নিরাপদ নয়। আমাদের কোনো বিকল্প নেই।”

শহরের দরিদ্র এলাকাগুলোর বাসিন্দারা নিয়মিত স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। কাবুলের আজারা এলাকার প্রবীণ এক নাগরিক জানান, “প্রতিদিন আমাদের বহু সময় পানির জন্য লাইন দাঁড়াতে হয়, আর সেই পানিই কখনও নিরাপদ নয়।”

নগরায়ন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ

গত দশকে কাবুলের জনসংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়েছে। নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি এবং অভিবাসী প্রত্যাবর্তনের কারণে শহরে মানুষের চাপ বেড়ে গিয়েছে। শহরের অবকাঠামো এবং পানির ব্যবস্থাপনা এই হারে জনসংখ্যার চাপ সামলাতে পারেনি।

অপরিকল্পিত বাড়ি নির্মাণ ও শিল্পবর্জ্যের অব্যবস্থাপনা পরিবেশ দূষণ বাড়িয়েছে এবং প্রাকৃতিক জলাধারগুলো ধ্বংসের ফলে পানির সঞ্চয় ক্ষমতা কমেছে।

আন্তর্জাতিক সংস্থার সতর্কতা: অর্থনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয় নেমে আসছে

মার্সি কর্পসের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, কাবুলের পানিসংকট যদি অব্যাহত থাকে, তবে এর প্রভাব হবে মারাত্মক—শহরের অর্থনীতি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে, মানবিক সংকট বাড়বে এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়বে।

ইউনিসেফের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে কাবুলের ভূগর্ভস্থ পানি সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যাবে যদি দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া না হয়। এর ফলে শহরের লাখ লাখ মানুষ পানির জন্য মারাত্মক সংকটের মুখে পড়বে।

সমাধান ও ভবিষ্যতের পথ

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাবুলে জরুরি ভিত্তিতে উন্নত পানি ব্যবস্থাপনা ও পুনঃরুদ্ধার প্রকল্প চালু করতে হবে।

  • জলাশয় পুনরুদ্ধার ও বৃষ্টি সংরক্ষণ: পাহাড়ি এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জলাধার নির্মাণ করতে হবে যাতে বৃষ্টির পানি জমে ভূগর্ভস্থ পানি পুনর্ভরণে সাহায্য করে।
  • অপরিকল্পিত নগরায়ন নিয়ন্ত্রণ: পরিকল্পিত নগর উন্নয়ন ও জল ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।
  • দূষিত পানি পরিষ্কার ও পুনর্ব্যবহার: আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে পানি নিষ্কাশন ও পরিশোধন করতে হবে।
  • সচেতনতা বৃদ্ধি: নাগরিকদের মধ্যে পানি সংরক্ষণের গুরুত্ব বাড়াতে শিক্ষা ও জনসচেতনতা কর্মসূচি চালু করতে হবে।

আফগান সরকার ও আন্তর্জাতিক সহায়তা নিয়ে কাজ করে দ্রুত এই সংকট মোকাবিলা করতে পারলে কাবুলকে আবারও পানির নিরাপদ নগরীতে পরিণত করা সম্ভব।

বিশ্বকে পাঠানো বার্তা: কাবুলের সংকট থেকে শিক্ষা নেওয়ার সময় এসেছে

বিশ্বের অনেক শহরই দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে একই ধরনের সংকটের মুখোমুখি হতে পারে। কাবুলের উদাহরণ থেকে দেখা যায়, পানি ব্যবস্থাপনা ও নগর পরিকল্পনায় অবহেলা কত বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, সতর্ক পরিকল্পনা ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় কাজ না করলে পৃথিবীর আরও অনেক আধুনিক নগর ভবিষ্যতে একই ঝুঁকিতে পড়বে।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button