বানিজ্য

দেশীয় ওষুধ কোম্পানি রেনাটাকে ৭০০ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে আইএফসি

আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানি রেনাটাকে ৫ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার বা প্রায় ৭০০ কোটি টাকার দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিচ্ছে। বৃহস্পতিবার (৮ মে) আইএফসি ও রেনাটার মধ্যে এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে দেশের ওষুধ খাতে অন্যতম বড় বিনিয়োগ বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে, যা শুধু রেনাটা নয়, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ও অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

চুক্তি স্বাক্ষরের পর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ঋণের এই অর্থ রেনাটার উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো, কাঁচামাল সরবরাহব্যবস্থাকে আরও স্থিতিশীল করা এবং নতুন পণ্য উদ্ভাবনের কাজে ব্যবহার করা হবে। এছাড়া, রপ্তানি কার্যক্রম সম্প্রসারণেও এই অর্থ বড় ভূমিকা রাখবে বলে কোম্পানিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

রেনাটার অগ্রযাত্রায় নতুন গতি আনবে এই বিনিয়োগ

দেশীয় ওষুধ খাতের অন্যতম পুরোধা প্রতিষ্ঠান রেনাটা লিমিটেড। ১৯৭২ সালে গঠিত এই কোম্পানি বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। দেশব্যাপী এর পণ্য সরবরাহ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা অর্জন ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠানটিকে এক ভিন্ন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। নতুন এই অর্থায়নের ফলে রেনাটার উৎপাদন ব্যবস্থা আরও উন্নত ও আধুনিক হবে। ফলে গ্রাহকদের কাছে মানসম্পন্ন ওষুধ আরও দ্রুত ও সাশ্রয়ী দামে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে।

রেনাটার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ এস কাইসার কবির এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “বর্তমান বৈশ্বিক ও স্থানীয় আর্থিক সংকটের মধ্যে এই ঋণ আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডলার সরবরাহে ঘাটতি, বিনিময় হারের অবমূল্যায়ন এবং দেশে অর্থায়নের উচ্চ খরচের প্রেক্ষাপটে আইএফসির এই পদক্ষেপ রেনাটার সরবরাহ শৃঙ্খলে স্থিতিশীলতা আনবে।”

অর্থনীতিতে ওষুধশিল্পের অবদান

বাংলাদেশের ওষুধশিল্প গত কয়েক দশকে অভূতপূর্ব উন্নতি করেছে। বর্তমানে দেশের প্রায় ৯৮ শতাংশ ওষুধ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয় এবং প্রায় ১৫০টি দেশে রপ্তানি করা হয় বাংলাদেশি ওষুধ। এতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে, পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে দক্ষ মানবসম্পদ ও প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসংস্থান।

আইএফসির দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ইমাদ এন ফাখুরি বলেন, “রেনাটার সঙ্গে আমাদের অংশীদারত্ব বাংলাদেশের ওষুধশিল্পের জন্য একটি বড় মাইলফলক। এই বিনিয়োগের মাধ্যমে শুধু কোম্পানির সক্ষমতা নয়, বরং সামগ্রিক শিল্পখাতের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান আরও মজবুত হবে। এতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থার বিকাশও ঘটবে।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, এই উদ্যোগ বাংলাদেশের জেনেরিক ওষুধ শিল্পকে বৈশ্বিক নেতৃত্বের দিকে নিয়ে যেতে সহায়ক হবে। রেনাটা আন্তর্জাতিক মানের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে, এবং এই অংশীদারত্ব সেই প্রচেষ্টার একটি বড় ধাপ।”

রেনাটার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও দৃষ্টিভঙ্গি

সংস্থাটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আইএফসির এই অর্থায়ন তাদের ভবিষ্যৎ সম্প্রসারণ পরিকল্পনার জন্য ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। কোম্পানিটি ইতোমধ্যে একাধিক দেশে রপ্তানি কার্যক্রম চালু করেছে, যার মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ। নতুন অর্থায়নের ফলে এই বাজারগুলোতে রেনাটার অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে।

এছাড়াও গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রমে বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে রেনাটা নতুন ওষুধ উদ্ভাবনের দিকে আরও মনোযোগী হতে চায়। কোম্পানির অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, ভবিষ্যতে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং ক্যানসারের মতো জটিল রোগের জন্য উচ্চমানের ওষুধ তৈরি করাই রেনাটার অন্যতম লক্ষ্য।

স্বাস্থ্যখাতে আস্থা বৃদ্ধি পাবে

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই অংশীদারত্ব বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের জন্য একটি আশাব্যঞ্জক বার্তা বহন করে। দেশে উচ্চমূল্যের ওষুধের সহজলভ্যতা ও মান বজায় রাখার ক্ষেত্রে রেনাটার সক্ষমতা গুরুত্বপূর্ণ। এই ঋণের ফলে প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘমেয়াদে আরও কার্যকরভাবে সেই ভূমিকা রাখতে পারবে।

বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যালস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক কর্মকর্তা বলেন, “ওষুধশিল্পের ওপর এখন আন্তর্জাতিক নজর রয়েছে। রেনাটার এই চুক্তি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াবে এবং খাতে আরও বিনিয়োগ উৎসাহিত করবে।”

আইএফসির লক্ষ্য ও প্রতিশ্রুতি

আইএফসি, যা বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীর একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান, দীর্ঘদিন ধরে উন্নয়নশীল দেশগুলোর বেসরকারি খাতে অর্থায়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করছে। বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে তারা ইতোমধ্যেই বিদ্যুৎ, কৃষি, অবকাঠামো, আর্থিক খাতসহ বিভিন্ন সেক্টরে বিনিয়োগ করেছে।

এই চুক্তির মাধ্যমে আইএফসি দেখিয়েছে, তারা বাংলাদেশকে শুধু অর্থনৈতিকভাবে নয়, মানবিক ও স্বাস্থ্যসেবার দিক থেকেও সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। ভবিষ্যতেও এই ধরণের অংশীদারত্ব আরও বিস্তৃত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

উপসংহার

আইএফসি ও রেনাটার এই অংশীদারত্ব বাংলাদেশের ওষুধশিল্পের জন্য এক ঐতিহাসিক মাইলফলক। এটি শুধু একটি কোম্পানির আর্থিক উন্নয়ন নয়, বরং সমগ্র স্বাস্থ্য খাত ও অর্থনীতিকে দীর্ঘমেয়াদে শক্তিশালী করবে। সরকারের নীতিগত সহায়তা, প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার এবং বৈশ্বিক বাজারে দক্ষতার ভিত্তিতে এই শিল্প আরও এগিয়ে যাবে—এমনটাই প্রত্যাশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button