ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা: একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কাঁপছে সীমান্ত অঞ্চল

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনায় ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বৃহস্পতিবার (৮ মে) রাতে পাকিস্তান কর্তৃক জম্মু ও কাশ্মীরসহ ভারতের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় চালানো ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ফলে পরিস্থিতি উদ্বেগজনক রূপ নিয়েছে। এসব হামলার প্রভাবে সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে ব্ল্যাকআউট কার্যকর করা হয়েছে, মোবাইল সেবা সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়েছে এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য উভয় দেশকে সংযমী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
হামলার বিবরণ ও ভারতের প্রতিক্রিয়া
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিয়ন্ত্রণ রেখা (Line of Control – LoC) বরাবর আরএস পুরা, আরনিয়া, সাম্বা এবং হীরানগরে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে মোট আটটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তাদের এয়ার ডিফেন্স ইউনিট এসব হামলা সফলভাবে প্রতিহত করেছে। এনডিটিভি’র একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তান রাতের আঁধারে বড় ধরনের হামলার চেষ্টা করেছিল, যা ভারতীয় সেনাবাহিনী নিষ্ফল করে দিয়েছে। এছাড়া, ভারতের পক্ষ থেকে পাল্টা হামলা হিসেবে লাহোর ও ইসলামাবাদে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের খবরও প্রকাশিত হয়েছে, যা উত্তেজনাকে আরও তীব্র করেছে।
পাঞ্জাবের পাঠানকোট শহরে একটি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে বলে সিএনএন’এর বরাতে জানা গেছে, যদিও এ ঘটনায় হতাহতের কোনো তথ্য এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এই হামলাগুলোর প্রেক্ষিতে ভারতের সামরিক বাহিনী উচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। জম্মু শহরের কিছু অংশে মোবাইল সেবা বন্ধ করা হয়েছে এবং সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে, যাতে আরও হামলার ঝুঁকি কমানো যায়। পাঞ্জাবের ফিরোজপুর ও গুরুদাসপুর, এবং রাজস্থানের পাকিস্তান সীমান্ত সংলগ্ন এলাকাগুলোতেও নিরাপত্তা সতর্কতার অংশ হিসেবে ব্ল্যাকআউট ঘোষণা করা হয়েছে।
পটভূমি: পহেলগাঁও হামলা ও ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা
এই সাম্প্রতিক হামলাগুলোর পেছনে রয়েছে গত ২২ এপ্রিল ভারত-শাসিত জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে সংঘটিত একটি সন্ত্রাসী হামলা, যেখানে ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন। এই হামলার জন্য ভারত সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করেছে, দাবি করে যে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লশকর-ই-তাইয়েবার সহযোগী গোষ্ঠী ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (TRF) এই হামলা চালিয়েছে। পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করলেও, ভারত কঠোর কূটনৈতিক ও সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
৬ মে ভারত ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে একটি সামরিক অভিযানের অধীনে পাকিস্তান ও পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, যার লক্ষ্য ছিল কথিত ‘সন্ত্রাসী অবকাঠামো’ ধ্বংস করা। পাকিস্তানের দাবি, এই হামলায় বেসামরিক এলাকা লক্ষ্য করা হয়েছে, যার ফলে তিনজন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে একজন শিশু ছিল। এই ঘটনার পর থেকে উভয় দেশই সীমান্তে সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়েছে, এবং নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর ছোট-বড় সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও উদ্বেগ
দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে এই উত্তেজনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস উভয় দেশকে ‘সর্বোচ্চ সংযম’ দেখানোর আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, “সামরিক সমাধান কোনো সমাধান নয়। এটি সহজেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প এই হামলাগুলোকে ‘লজ্জাজনক’ আখ্যা দিয়ে পরিস্থিতির দ্রুত অবসানের আহ্বান জানিয়েছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল্লাহ বিন যায়েদ উভয় দেশকে উত্তেজনা না বাড়িয়ে সংযত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। চীনও এই পরিস্থিতি নিয়ে ‘দুঃখ’ ও ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছে।
সীমান্তবর্তী এলাকায় জনজীবন
নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছাকাছি এলাকার বাসিন্দারা চরম আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, পহেলগাঁও হামলার পর থেকে সীমান্ত এলাকার মানুষ যুদ্ধের আশঙ্কায় বাঙ্কার সংস্কার ও জরুরি প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। মুজাফফরাবাদে ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর বিস্ফোরণ ও বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ঘটনা ঘটেছে, যা স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ভীতি আরও বাড়িয়েছে। পাকিস্তানের পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী মারিয়ম নওয়াজ জনগণকে ঘরে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
ভারতের শ্রীনগরে বাসিন্দারা আকাশে ভারী যুদ্ধবিমানের শব্দ শুনেছেন বলে জানিয়েছেন, যা পরিস্থিতির গুরুত্ব আরও প্রকট করেছে। স্থানীয় প্রশাসন জনগণকে শান্ত থাকার এবং সরকারি নির্দেশনা মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছে।
কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক পদক্ষেপ
ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একাধিক কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। পাকিস্তান থেকে সব ধরনের পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে পাকিস্তানের ঋণ পর্যালোচনার অনুরোধ জানানো হয়েছে। এছাড়া, সিন্ধু নদের পানি বণ্টন চুক্তি স্থগিতের হুমকি দেওয়া হয়েছে, যা পাকিস্তানকে ক্ষুব্ধ করেছে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ এই পদক্ষেপকে ‘আগ্রাসন’ হিসেবে আখ্যায়িত করে পাল্টা হামলার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বিশ্লেষকদের মতে, দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে এই উত্তেজনা যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে পারে, যা দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি এই উদ্বেগকে আরও বাড়িয়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যস্থতা এবং কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা এখন সময়ের দাবি। উভয় দেশের নেতৃত্বকে শান্তিপূর্ণ সমাধানের দিকে এগিয়ে যেতে হবে, যাতে সীমান্তবর্তী এলাকার নিরীহ মানুষ আরও দুর্ভোগের শিকার না হয়।