ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের মধ্যেই মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা

মধ্যপ্রাচ্যের জটিল পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠল, যখন ইরান কাতারে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বড় সামরিক ঘাঁটি আল-উদেইদ বিমানঘাঁটিকে নিশানা করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। যদিও কাতারের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হামলাটি আকাশেই ধ্বংস করে দেয়, তবে এই ঘটনা অঞ্চলে নতুন করে উত্তেজনার মাত্রা বৃদ্ধি করেছে।
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা: কাতারের আল-উদেইদ বিমানঘাঁটি লক্ষ্য
গত সোমবার রাতে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড কোর (আইআরজিসি) ঘোষণা দেয়, তারা কাতারের মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এটি ঘটে ইরানের তিনটি পরমাণু স্থাপনায় মার্কিন হামলার মাত্র দুই দিনের মধ্যে। আইআরজিসি বলেন, ইরানের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার ওপর হামলার জবাবে তারা কোনও ছাড় দিবে না। একই সঙ্গে তারা স্পষ্ট করেছে, এই হামলা কাতার বা কাতার জনগণের বিরুদ্ধে নয় এবং এটি কেবল মার্কিন সামরিক ঘাঁটিকে লক্ষ্য করে চালানো হয়েছে।
হামলার সময় কাতারে পরিস্থিতি: আতঙ্ক ও সাইরেনের শব্দ
হামলার সময় কাতারের রাজধানী দোহায় বিস্ফোরণের শব্দে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় বাসিন্দারা সিএনএন-কে জানান, আকস্মিক বিস্ফোরণের কারণে তাদের শিশুরা ভয়ে চমকে ওঠে। কাতার সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়, এই হামলায় কোনো নাগরিক বা সামরিক কর্মী হতাহত হয়নি, কারণ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ধ্বংস করেছে।
কাতারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী শেখ সৌদ বিন আবদুল রহমান বলেন, হামলায় ব্যবহার করা ক্ষেপণাস্ত্রগুলো আকাশেই ধ্বংস হয়েছে। কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকার কথা জানায় এবং উদ্বেগের কোনো কারণ নেই বলে বিবৃতি দেয়।
মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশেও নিরাপত্তা সতর্কতা
কাতারে হামলার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কুয়েত, বাহরাইন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত তাদের আকাশসীমা বন্ধ করে দেয়। বাহরাইনে সাইরেন বাজানো হয়, বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বলা হয়। ইরাকের আল-আসাদ বিমানঘাঁটিতেও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে, যদিও সেখানে কোনো হামলার খবর পাওয়া যায়নি। ইরাকের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও কাতারে হামলার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের ভৌগলিক ও সামরিক গুরুত্ব
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান ঘাঁটিগুলোর মধ্যে আল-উদেইদ বিমানঘাঁটি অন্যতম। ১৯৯৬ সালে কাতারের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে স্থাপিত এই ঘাঁটিতে প্রায় ১০ হাজার মার্কিন সেনা অবস্থান করে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে—ইরাক, বাহরাইন, কুয়েত, সৌদি আরব, সিরিয়া, এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে—যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি রয়েছে, যেখানে মোটামুটি ৩০ হাজার মার্কিন সেনা থাকে, বড় কোনো অভিযানের সময় এই সংখ্যা অনেক গুণ বেড়ে যায়।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত: দিন দিন বাড়ছে উত্তেজনা
গত ১৩ জুন থেকে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা চলছে। ২১ জুন রাতে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি পরমাণু স্থাপনায় বিমান হামলা চালায়। এরপর থেকে তেহরান কড়া প্রতিশোধের হুমকি দিয়েছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি এবং অন্যান্য উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বারবার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর সুরে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
গতকাল ইরানের আইআরজিসি ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে দিনের বেলায় ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, যা সাধারণত রাতের বদলে দিনের প্রথম বড় হামলা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তেল আবিব, সাফাদ, আশকেলন, আশদদ, বেইসান ও পশ্চিম জেরুজালেমে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত লাগে, দক্ষিণ ও মধ্য ইসরায়েলে সাইরেন বাজে প্রায় ৩৫ মিনিট ধরে।
ইরানে ইসরায়েলি বিমান হামলা: ১০ জন আইআরজিসি সদস্য নিহত
ইসরায়েলি বাহিনী জানিয়েছে, গত ২২ জুন রাতে তারা প্রায় ২০টি যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে ইরানের কেরমানশাহ প্রদেশ ও তেহরানের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। এই হামলায় আইআরজিসির অন্তত ১০ সদস্য নিহত হয়েছে। ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সামরিক ও বেসামরিক মিলিয়ে ইতিমধ্যে প্রায় ৫০০ জন নিহত হয়েছেন।
পরমাণু স্থাপনায় ক্ষতি ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র ২১ জুন রাতে ইরানের পরমাণু স্থাপনায় বিমান হামলা চালায়। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা আইএইএ জানিয়েছে, ফর্দো ও নাতাঞ্জ পরমাণু কেন্দ্রগুলোতে উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এরপর ইসরায়েল আরও একবার ফর্দো কেন্দ্রের কাছে হামলা চালায়।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: নিন্দা ও সমর্থন
সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ফ্রান্সসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ এই হামলার তীব্র নিন্দা জানায়। ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ সবাইকে সংযত থাকার ও আলোচনা টেবিলে ফিরে আসার আহ্বান জানান।
রাশিয়া ও চীনসহ কয়েকটি দেশ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব করেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইরানের পাশে থাকার ঘোষণা দেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলছেন।
মার্কিন সরকারের অবস্থান ও ভবিষ্যৎ প্রেক্ষাপট
হোয়াইট হাউসের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, তারা এখনো কূটনৈতিক সমাধানের জন্য আগ্রহী, তবে ইরানের সরকারের প্রতি কঠোর অবস্থান নিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভাষ্য ও হোয়াইট হাউসের বিবৃতি থেকে বোঝা যাচ্ছে, ইরানের বর্তমান সরকার যদি শান্তিপূর্ণ সমাধানে না আসে, তবে সেখানে পরিবর্তনের প্রয়োজন হতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরানের সরকার পরিবর্তন হলে তা অঞ্চলে স্থিতিশীলতার জন্য বিপজ্জনক হতে পারে এবং গৃহযুদ্ধের আশঙ্কাও দেখা দিতে পারে।
সংক্ষেপে: কেন গুরুত্ব পূর্ণ এই সংঘাত?
- মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ইরানের হামলা: মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ও প্রভাবের বিরুদ্ধে সরাসরি হুমকি।
- ইরান-ইসরায়েল সংঘাত: দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক, সামরিক ও ধর্মীয় দ্বন্দ্বের তীব্র রূপ।
- পরমাণু স্থাপনায় আঘাত: অঞ্চলে শক্তির ভারসাম্য ও পারমাণবিক সম্ভাবনার প্রশ্ন।
- আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: বিশ্বশক্তিগুলোর ভিন্ন মিত্রতা ও রাজনৈতিক কৌশল।
- সামাজিক ও মানবিক প্রভাব: স্থানীয় মানুষের নিরাপত্তা ও জীবন বিপন্ন।
মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে তীব্র সংঘাত ও মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের হামলার ঘটনা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন এক উত্তেজনা ও চ্যালেঞ্জের সূচনা করেছে। আগামীতেও এই অঞ্চল থেকে বড় ধরনের নিরাপত্তা সংকট এবং কূটনৈতিক উত্তেজনার খবর আসতে পারে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ নেওয়া এখন অত্যন্ত জরুরি।